নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ
|
৩১ আশ্বিন ১৪২৯ |
Sunday, October 16, 2022
খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে রয়েছে দেশ। কিন্তু সব মানুষের জন্য এখনো নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা যায়নি। বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশে সবার জন্য নিরাপদ খাদ্যের জোগান দেয়াকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে সরকার। দেশে উৎপাদিত মাছ, মাংস, ডিম, দুধ দিয়েই চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও সরকারি গুদামে ১৬ লাখ ৬৯ হাজার মেট্রিক টন চাল-গম মজুত আছে। বাজারে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি হলেও কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য নিম্নবিত্তদের কম দামে দিচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ পালন করা হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’। কৃষি মন্ত্রণালয় আজ সোমবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে সেমিনারের আয়োজন করেছে। খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘চালে আমরা অনেক আগে থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বছরে ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা থাকলেও দেশে ১০ লাখ টন গম উৎপাদন হয়। আবহাওয়ার কারণে দেশে বেশি গম উৎপাদন না হওয়ায় আমদানি করতে হয়। খাদ্য সচিব বলেন, দেশ চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা, যুদ্ধের কারণে সম্ভাব্য খাদ্যসংকট হওয়ার শঙ্কা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মাথায় রেখে কিছু চাল আমদানি করা হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশ সব সময়ই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে।
কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার কারণে দানাদার, পুষ্টিজাতীয় এবং সুষম খাদ্য উৎপাদনের হার অনেক বেড়েছে। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে খাবারের জন্য বাংলাদেশকে কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। দেশে বছরে ২৪ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকলেও দেশি তেলবীজ থেকে তিন লাখ টন তেল পাওয়া যায়। ফলে আগামী তিন বছরে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে তেলবীজ জাতীয় ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার ৪০ থেকে ৫০ ভাগ উৎপাদন করা হবে।
সব ধরনের খাদ্যপণ্যের জোগান থাকলেও সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার মতো সমক্ষতা এখনো হয়নি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, দেশ অনেক ক্ষেত্রেই খাদ্যে নিরাপত্তা অর্জনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে সবার জন্য সব ধরনের খাদ্য সরবরাহ করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বন্যা, সাইক্লোন, জলাবদ্ধতাসহ বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। এখন ডলারের দাম বেড়ে গেছে, যুদ্ধ চলছে। ফলে খাদ্য আমদানি ও সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে, এরপরেও দেশে খাবারের কোনো সংকট নেই।
তিনি বলেন, ‘খাবার নিরাপদ ও পুষ্টিকর কিনা সেই জায়গায় আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারিনি। নিরাপদ মানের খাদ্য সবার কাছে পৌঁছানোর সক্ষমতা সবার তৈরি হয়নি। অনেক কৃষকের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ফলে তারা ইচ্ছামতো সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে ফসল ফলাচ্ছেন। এতে করে উৎপাদনের সময়ই অনেক খাদ্যপণ্য নিরাপদ থাকছে না। এসব পণ্য সঠিক নিয়মে পরিবহন না করায় সে সবের মান নষ্ট হচ্ছে। খবার সংরক্ষণে সবাই নিয়ম মানছেন না। যে রাসায়নিক ব্যবহার করে খাবার সংরক্ষণ করার কথা তার থেকে কম দামের রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউ কেউ নির্ধারিত পরিমাণের বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। আমরা এগুলো অ্যাড্রেস করছি।’
অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও শিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ের ধারণায় পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ। তিনি বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। নিজের বাসায় নিরাপদ খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সবার আগে মানুষের মধ্যে নিরাপদ খাবারের চাহিদা তৈরি করতে হবে। এ চাহিদা তৈরি হলে কেউ আর অনিরাপদ খাবার বিক্রি করতে পারবে না।
বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, ‘প্রায় ৭৫ শতাংশ দরিদ্র ও খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষ তাদের জীবনযাত্রার জন্য কৃষি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী দেখা দেয়ার প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি খাদ্যপণ্য উচ্চমূল্যে বিশ্ববাজারে রপ্তানির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।’
প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আনার তাগিদ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিমিত পরিমাণে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ মৌসুমি ফলমূল, শাকসবজি, প্রাণিজ আমিষ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।’
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেছেন, ‘সরকারের গৃহীত কৃষিবান্ধব নীতি ও কার্যক্রমে দানাদার খাদ্য, মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। ধান, পাট, আম, পেয়ারা আলু প্রভৃতি ফসল ও ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ৮টি দেশের মধ্যে রয়েছে। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতসহ কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে উত্তম কৃষিচর্চা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।’ (দৈনিক বাংলা)