দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জবাবদিহির অভাব
|
৩১ আশ্বিন ১৪২৯ |
Sunday, October 16, 2022
দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা কেমন চলছে, এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রায় বা সিদ্ধান্তেরও কোনো দরকার নেই। আমরা সবাই কমবেশি জানি ব্যাংকিং সেক্টর কেমন চলছে। বিশ্বব্যাংক ভালো বললেও তো আমরা বলতে পারব না যে, ব্যাংকিং সেক্টর ভালো চলছে। কোনো দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গেলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত ভারসাম্য বজায় রেখে কথা বলে থাকে। তারা প্রথমে প্রশংসা করে। তারপর কিছুটা সমালোচনা করে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করেনি এমন কোনো আমল নেই। অর্থাৎ সব সরকার আমলেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা সমালোচনাও করেছে। তারা সবসময়ই ভারসাম্য বজায় রেখে কথা বলে। আর ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমান যে অবস্থার সৃষ্টি, খেলাপি ঋণ আগেও ছিল। কিছু লোক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দিত না। এ জন্য ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়ত। তারপরও ব্যাংকগুলো কিছুটা হলেও নিয়মকানুন মেনে চলার চেষ্টা করত। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ গ্রহণ এবং ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য কোনো নিয়মকানুনের প্রয়োজন হয় না, যদি তাদের সঙ্গে সরকারের ভালো সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে এখন ব্যাংকিং সেক্টরে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। এ জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না, তাদেরই বারবার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। যারা সৎ এবং ভালো ঋণগ্রহীতা তাদের তেমন কোনো সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে না। ফলে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীরা হতাশ এবং নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। কোনো কোনো ব্যাংকের মালিকানা এবং ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু মুখচেনা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের অনেকবার বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে চলেছেন, তাদের তেমন কোনো সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে না।
ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা ঘোষণার মধ্যেই ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। ব্যাংক থেকে টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আগামীতে কেউ আর ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ করার জন্য উৎসাহ বোধ করবে না। কারণ তারা দেখছে, ঋণের কিস্তি ফেরত না দিলেও কোনো অসুবিধা হয় না। বরং বারবার তাদের সুবিধা প্রদান করা হয়। কেউ যদি ঋণখেলাপি হয়, তাহলে তার সুবিধা অনেক বেশি। কেউ যদি ঋণখেলাপি হয়, তাহলে তাকে সুদ প্রদান করতে হয় কম হারে। তার আরও বেশি ঋণ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। সরকারের কাছে ঋণখেলাপির মর্যাদাও যেন বেশি থাকে। আর যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, তাদের মর্যাদা থাকে কম। তারা চাপের মধ্যে থাকেন। এ ধরনের একটি ভয়ংকর অন্যায় ব্যাংকিং খাতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। প্রতি বছর দেশ থেকে যে ৭০ হাজার কোটি থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়, এটা এই গোষ্ঠীর মাধ্যমেই হচ্ছে।
বর্তমানে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ এবং অবলোপনের নীতিমালা সহজীকরণ করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর উদ্দেশ্য খেলাপি ঋণ আদায় করা নয়। বরং কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো। আগেও এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
উলেস্নখ্য, ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের নীতিমালা সহজীকরণের ফলে খেলাপি ঋণ কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যাবে। কারণ খেলাপি ঋণ আদায় না করেও তাকে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ না দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী যেভাবে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছেন, তা অব্যাহত থাকলে আগামীতে দেখতে পাব, ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। যদি ঋণের কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানো যেত, তাহলে অবশ্যই তাকে ধন্যবাদ দেওয়া যেত; কিন্তু তা তো হচ্ছে না। বাস্তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগামীতে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে। এটা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে। পুরো কাজটিই হচ্ছে হিসাবের মারপঁ্যাচ। অর্থমন্ত্রী যুক্তি দিয়েছেন তার এসব সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এখানে কৃত্রিম উপায়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, যারা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে শীর্ষ ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত, তাদেরই অনেকে এখন নীতিনির্ধারণ করছেন। সমস্যাটি হচ্ছে, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন, তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে আছেন। আইনগতভাবেও এটা হতে পারে না। এটা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হয়। যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকেন, তাদের প্রতিষ্ঠান এভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে পারে না। সিদ্ধান্ত যেহেতু তারাই নিচ্ছেন, তাই সব সিদ্ধান্তই তাদের স্বার্থের অনুকূূলে যাচ্ছে। যারা ঋণখেলাপি তারাই সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। কাজেই এখানে ন্যায়বিচার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্যাংকিং খাত এমন একটি অবস্থার মধ্যে পড়ার কারণে আসলেই এই খাতটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’তে পরিণত হয়েছে। সরকার থেকে পাবলিক মানি দিয়ে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করা হচ্ছে। সেই টাকা ব্যাংকিং খাতে না থেকে চলে যাচ্ছে কিছু মানুষের পকেটে। এই অবস্থায় নিয়মমাফিক ঋণ গ্রহণ করা এবং বিনিয়োগ কার্যক্রম সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত হবে। আগামীতে ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হবে। আরও বেশি তারল্য সংকট দেখা দেবে। সরকারি প্রকল্প অর্থায়নের জন্য আবারও জনগণের ওপর চাপ দিতে হবে। ফলে গণদুর্ভোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে অবস্থার মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে আগামীতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ব্যাংকিং খাতের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকার কথা নয়। অবশ্য এভাবে যদি অর্থ পাচার হয়, তাহলে সেটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের ফিন্যান্সিয়াল দানবরা বেশ পছন্দ করবেন। কারণ এভাবে কোনো দেশের অর্থ লুণ্ঠন হলে তারা লাভবান হতে পারবেন। বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় অনেক ব্যাংক আছে, যাদের গতিপ্রবাহ নির্ভর করে অন্য দেশের অবৈধ টাকার ওপর। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা অবৈধ অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছ থেকে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রশংসিত হতে পারে।
সরকার এখন একচেটিয়া ক্ষমতায় আছে। সরকারের জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের আকাঙ্ক্ষা এবং লোভ বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। সরকার এখন চাইলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তাই সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজন আরও সহজে কীভাবে টাকা বানানো যায়, সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। আর বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টর হচ্ছে টাকা বানানোর একটি চমৎকার ক্ষেত্র। ফলে অনেকেই ব্যাংক স্থাপন করতে চাচ্ছে। সরকারও প্রয়োজন থাক আর না-ই থাক, ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। পাবলিক মানি লুণ্ঠন করার জন্য ব্যাংকিং সেক্টরকে একটি চমৎকার মাধ্যম হিসেবে দেখছেন অনেকেই। আর এ কারণেই ব্যাংক স্থাপনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মধ্যে এখন আর কোনো সংঘাত নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় যা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটাই বাস্তবায়ন করে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আলাদা কোনো সত্তা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নির্দেশনায় অন্য ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে গুরুত্ব এবং দায়িত্ব তার কোনো বহিঃপ্রকাশ আমরা এখন আর দেখছি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের স্বাধীন এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করছি না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি হয়ে গেল তার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করা হলো না। যারা এই অপকর্মের জন্য দায়ী, তাদের এখনো শনাক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী একটি মহল দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছে এবং তাদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক যে শক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক যে দায়িত্ব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে দূরদর্শী যে প্রক্রিয়া, তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণখেলাপিদের যেভাবে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তাতে আগামীতে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বেই। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে যে তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে, সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যাদের হাতে বিরাট অঙ্কের টাকা জমা আছে, তাদের আয়ের একটি বড় অংশই হচ্ছে অবৈধ আয়। এই অবৈধ আয়ের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক হিসাবের মধ্যে নেই। এগুলো হিসাবের মধ্যে আনা গেলে দেখা যাবে বৈষম্য আরও অনেক বেশি। যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে এবং কিছু লোকের হাতে অর্থ পুঞ্জীভূত করার ব্যবস্থা হচ্ছে, তাতে আগামীতে দেশের মানুষের আয়বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে।
ম লেখক : আনু মুহাম্মদ
অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়