করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গভীর সংকটে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। তবে এখনো অর্থনীতিতে কঠিনতম সময় আসেনি। আগামী বছর এ ধরনের সংকট মোকাবিলা করতে হতে পারে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি সামনে আরও খারাপ হবে। খাদ্য পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশগুলোকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক।
শনিবার আন্তর্জাতিক এ সংস্থা দুটির আলাদাভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে সংস্থা দুটির চলমান বার্ষিক সাধারণ সভা উপলক্ষ্যে এসব প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক যে মন্দা চলছে, আগামী বছর তা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। ওই সময়ে খাদ্য সংকট তীব্র হবে। চড়া মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও জ্বালানি খরচ বাড়ার কারণে অনেক পণ্যের দাম বাড়বে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। এতে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না থাকলে আমদানি করা যাবে না। তখন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কঠিনতম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। দেখা দিতে পারে সামাজিক অস্থিরতা। এসব বিবেচনায় আইএমএফ বাংলাদেশসহ স্বল্প ও মধ্য আয়ের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। তারা বলেছে, যথেষ্ট রিজার্ভ থাকলে বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হবে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে অনেক দেশের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তা বিপজ্জনক মাত্রায় চলে এসেছে। সাধারণ নিরাপদ মান অনুযায়ী কমপক্ষে ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ নেই। বর্তমান সংকটের মধ্যে কমপক্ষে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকা উচিত। যা অনেক দেশেরই নেই। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলংকা ও পাকিস্তান এখন রিজার্ভ নিয়ে বড় সংকটে ভুগছে।
রিজার্ভের এই উত্থান-পতনে বৈশ্বিক রিজার্ভ পরিস্থিতিও কমে গেছে। গত বছরের জুনে বৈশ্বিকভাবে রিজার্ভ ছিল ১২ লাখ ৮১ হাজার কোটি ডলার। জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪ হাজার কোটি ডলারে। এক বছরে বৈশ্বিক রিজার্ভ কমেছে ৭৭ হাজার কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে রিজার্ভ ৭ লাখ ৭ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৫ হাজারে নেমেছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রপ্তানি বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ মেটানো হয় ডলার দিয়ে। আগে এ হার ছিল ৬০ শতাংশ। বৈদেশিক বাণিজ্যে ডলারের অবস্থান শক্তিশালী হওয়ায় বিভিন্ন দেশ তাদের রিজার্ভের বড় অংশ ডলারেই সংরক্ষণ করে। এ কারণে ডলারে রিজার্ভ বেশি। বর্তমানে ডলারের দাম বাড়ায় অনেক দেশ আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের ব্যবহার কমাচ্ছে। ব্যবহার করছে বিকল্প মুদ্রা। এতে সংশ্লিষ্ট মুদ্রায় রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। কমছে ডলারের রিজার্ভ।
রিজার্ভ সংরক্ষণের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরো। গত বছরের জুনে এ মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি ডলার। জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ কমেছে ২৫ হাজার কোটি ডলার। রিজার্ভ সংরক্ষণে তৃতীয় অবস্থানে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড। গত এক বছরের ব্যবধানে এ মুদ্রার রিজার্ভ ৫৬ হাজার ৯০ কোটি ডলার থেকে কমে ৫৪ হাজার ৫০৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ কমেছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার।
চীনা মুদ্রায় রিজার্ভ রাখার প্রবণতা এখন বাড়ছে। গত এক বছরে এতে রিজার্ভ সাড়ে ৩১ হাজার কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৩২ হাজার কোটি ডলারের বেশি হয়েছে। জাপানি মুদ্রা ইয়েনে রিজার্ভ ৬৭ হাজার কোটি ডলার থেকে কমে ৫৮ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান ডলারে ২২ হাজার কোটি থেকে কমে ২১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। কানাডিয়ান ডলারে রিজার্ভ বেড়েছে। কারণ সে দেশে বিদেশিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে বিনিয়োগ বাড়ছে। এতে এ মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে। গত এক বছরের ব্যবধানে এ মুদ্রায় রিজার্ভ ২৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে। আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ বেড়েছে ১ হাজার কোটি ডলার। সুইজারল্যান্ডের মুদ্রা সুইস ফ্রাঙ্কেও রিজার্ভ বেড়েছে। গত বছরের জুনে ছিল ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। জুনে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ বেড়েছে ৫০০ কোটি ডলার। অন্যান্য মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ হাজার কোটি ডলার থেকে কমে ৩৫ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সাল থেকে ডলারে বৈশ্বিক রিজার্ভ কমেছে ৫৯ শতাংশ। যা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আলোচ্য সময়ে মার্কিন ডলার, ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন ও অস্ট্রেলিয়ান ডলারে রিজার্ভ কমেছে, বেড়েছে আরএমবি, কানাডিয়ান ডলার, সুইস ফ্রাঙ্ক।
বাংলাদেশের রিজার্ভও কমে এসেছে। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ৪ হাজার ৮০৮ কোটি ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ৩ হাজার ৬৩৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আগামী মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দেনা শোধ করলে তা ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসতে পারে।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না থামাতে পারলে পণ্য উৎপাদন কমে যাবে। পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাও বাধাগ্রস্ত হবে। এতে বিশ্ব অর্থনীতি পঙ্গুত্বের দিকে এগিয়ে যাবে। করোনার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা কটিয়ে উঠার আগেই যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়েছে অর্থনীতি। এতে খাদ্য সংকট বেড়ে যাবে। স্বল্প ও মধ্য আয়ের কমপক্ষে ৪৮টি দেশ চরম খাদ্য অনিশ্চয়তায় রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অর্জিত সভ্যতা পেছন দিকে যাত্রা শুরু করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলা করতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঋণ দিতে ৪ হাজার কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে। এ তহবিল থেকে বাংলাদেশসহ জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ পাবে। এ খাতে গত অর্থবছরে ৩ হাজার ১৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বিদ্যমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বিশেষ ঋণের পাশাপাশি অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। আইএমএফ বলেছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে শুধু বহুজাতিক সংস্থার ঋণের ওপর নির্ভর করা উচিত হবে না। তাদের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ধার বা সোয়াপ করার আগাম ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। যাতে বিপদে কাজে লাগানো যায়।
সূত্র জানায়, শ্রীলংকাকে সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ২০ কোটি ডলারের সোয়াপ সুবিধা দিয়েছে। শ্রীলংকা এখন তা পরিশোধ করতে পারছে না। তিন দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যা আগামী মার্চের মধ্যে পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যেও তাদের পক্ষে ওই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। কেননা, শ্রীলংকার অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও পুনরুদ্ধার হয়নি। এ অবস্থায় কোনো দেশ কারেন্সি সোয়াপ সুবিধা দেবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।