বগালেক : যেন বাংলাদেশের স্বর্গ
|
৩ কার্তিক ১৪২৯ |
Tuesday, October 18, 2022
এখন থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে দৈনিক বাংলার বার্তা সম্পাদক মরহুম ফওজুল করিম তারা ভাইয়ের কাছে বগালেকের গল্প শুনেছিলাম। দুর্গম পাহাড়িপথ হেঁটে তিনি বগালেক দেখতে গিয়েছিলেন। এই লেক সমুদ্র পিষ্ঠ থেকে সাড়ে ১২শ ফুট উঁচুতে এক প্রাকৃতিক জলাধার। কিভাবে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা দিয়েছিলেন। তখন থেকেই মনে হয়েছিলো যদি একবার সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে বগালেক দেখতে পেতাম! বান্দরবানের রুমা উপজেলা কেন্দ্র থেকে এখন ১৫ কিলোমিটার পথ। আগে সেখানে যাবার ব্যবস্থা ছিলো পায়ে হেঁটে। দুঃসাহসী পর্যটকেরা একজন উপজাতীয় গাইট সঙ্গে নিয়ে চাল ডাল মুরগি নিয়ে গিয়ে হাজির হতেন বগালেক এলাকায়। কিছু অর্থের বিনিময়ে উপজাতীয় লোকেরা সে সব রান্না করে দিতো। থাকবার ব্যবস্থা ছিলো তাদের ঘরের বারান্দার কিংবা যদি অতিরিক্ত রুম থেকে থাকে সেখানে। তার জন্য কোন টাকা পয়সা দিতে হতো না। তারাভাই বগালেকে যেতে পথে পাহাড়ি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা ছিলেন চারপাঁচ জন। তখনও সেখানে টিনের ঘরের প্রচোলন ছিলো না। ছন ও বাঁশের ধারা তৈরি হতো ছোট ছোট গোল ঘর। সেখানেই বসতি ছিলো উপজাতীয় বাসিন্দারের।
প্রায় ১৫ বছর আগে আমার মেয়েসহ একদল বগালেক ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলো। ওরাও এসে একই রকম বর্ণনা দিয়েছিলো। বাংলাদেশে এরকম লেক দ্বিতীয়টি নেই। বান্দরবান থেকে বগালেক পর্যন্ত দূরুত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। আগে সড়ক পথ ছিলো না, পায়ে হাঁটার কোন বিকল্প ছিলো না। এমনকি আমার মেয়ে যখন বগালেক ভ্রমণে গিয়েছিলো তখনো সেখানে থাকবার কোন আয়োজন ছিলো না। ওরা সবাই তার রোমাঞ্চকর বর্ণানা দিয়েছিলো। বান্দরবানকে এমনিতেই বলা হয় বাংলাদেশের দার্জিলিং। থরে থরে সাজানো পাহাড়। কোন কোন পাহাড়ের উপরে দাঁড়ালে কখনো কখনো নিচের বৃষ্টিপাত চোখে পাড়ে। কখনো কখনো হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেয়া যায়। থরে থরে সাজানো পাহাড় কুয়াশায় ঢেকে থাকে কখনো। কখনো সূর্যের আলোর ঢেউ খেলে যায়। তার মধ্যে আমারাও ঠিক করলাম জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বগালেকটা একবার দেখে যাই। অনেকে আমাদের নিরুৎসাহিত করেছেন। তারা বলেছেন, জায়গাটা সুন্দর কিন্তু অতন্ত দুর্গম। রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত খাড়া পাহাড়,গভীর গিরি খাত আর চরম আকাঁবাকাঁ সড়কপথ। এই পথকে ভয়ঙ্করই বলা যায়। গাড়ি কিংবা মটর সাইকেল ছাড়া এই পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। একসময় নিশ্চয় সড়ক ভালো ছিলো। এখন অনেক খানাখন্দে ভড়ে গেছে তবে রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত একটি সড়কের অস্তিত্ব আছে। প্রধান যানবাহন চাঁদের গাড়ি। ফোর হুইল ড্রাইভ তিনি হাজার সিসির পুরোনো গাড়ি রিমডেলিং করে এই পথে চলার উপযোগি করা হয়েছে। গাড়ির গতি হতে হবে কমপক্ষে ঘন্টায় ৬০-৮০ কিলোমিটার এর থেকে কম গতি হলে গাড়ি উচুঁ পাহাড়ে উঠতে পারবে না। হয়তো উল্টে পড়ে যাবে। তবে সেরকম দুর্ঘটনার কথা খুব একটা শোনাযায় না। রুমা পর্যন্ত আমারা একটা ভালো গাড়িতে গিয়েছি, চাঁদের গাড়িতে নয়। কিন্তু রুমা গিয়ে গাড়ি বদলাতে হলো-চাঁদের গাড়ি। বগালেকের আয়তন প্রায় ১৫ একর। পানির গভীরতা কোথাও কোথাও ১১৫ ফুট পর্যন্ত। চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় তার মাঝখানে নীল পানির বগালেক।
রুমা থেকে যখন চাঁদের গাড়িতে উঠলাম তখন সবাই গাড়ির তরুণ চালককে একটাই পরামর্শ দিতে থাকলেন ধীরে চালাবে দেখেশুনে চালাবে। যার এই দুর্গম পথে গাড়ি চালায় তাদের প্রতিটা বাগ প্রতিটা উত্থান গীরিখাতে নেমে পরা সবকিছু মুখস্ত থাকতে হয়। সামান্য এদিক সেদিক হলে হাজার ফুট নিচে পতন অবধারিত।
আমারা এইসব উত্থান পতন আর বাগগুলো যখন পের হচ্ছিলাম তখন খুব শক্তকরে ধরেছিলাম গাড়ির রেলিং। যাওয়ার পথটা দুর্গম পথ তবে নয়নাভিরাম যেদিকে তাকাবে দুচোখ জুড়িয়ে যাবে। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে দিবে। গাড়িটি ৮০ কিলোমিটার চলছিলো। এই ১৫ কিলোমিটার যেতে বাঁক বুক ম্যানেজ করতে ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম। তারপর একসময় সেই নীল পানির বগালেকে। এখন আশেপাশে গড়ে উঠেছে টিনের একতলা দোতলা ঘর। যেখানে পর্যটকদের থাকবার ব্যবস্থা আছে। দু একটি খাবার হোটেল আছে। পর্যটক যায় বলে উপজাতীয়দের কুটির শিল্পের দোকানপাটও আছে। আমরা যখন বগালেক পৌঁছালাম তখন প্রায় ১টা বাজে। ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থা বসলাম লেকের ধারে। ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। পানিতে চিকচিক করছে সূর্যের আলো,ফুঁটে আছে লাল শাপলা। তীরে বড় বড় গাছ। গাছে ঝুলছে বড়বড় পাতার মানিপ্লান্ট। পাশের দোকান থেকে চা খেলাম। আস্তে আস্তে শরীর জুড়িয়ে যেতে থাকলো সিনিগ্ধ হাওয়ায় কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা পথের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার স্ত্রী আর এক সহপাঠিনী ও তার স্বামী। সবারই বয়স ৭০ এর কোঠায়। বাকিসব পর্যটক একিবারে তরুণ, ৩০ এর মধ্যে তাদের বয়স। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমাদের আসে পাশে ভীড় করলো তরুণেরা। তারা বললো, আংকেল আপনাদের সাহসতো কম নয়। এই বয়সে বগালেক দেখতে এসেছেন। সত্যি বলতে কি এই দুর্গম পথে যেতে যেতে একবারও মনে হয়নি আমাদের বয়স হয়ে গেছে। বয়স যেন আমরা অনেকটা ফিরে পেলাম বগালেকে গিয়ে। থাকবার যেটুকু আয়োজন আছে সেখানে বিলাসিতা নেই। কিন্তু ইচ্ছে করলে বগালেকের পাড়ে রাত্রিটা কাটিয়ে দেয়া যেত। আমাদের ধারণা ছিলো না সেখানে রাত্রি কাটানো সম্ভব। সে একটা ভুল হয়ে গেলো। পরে মনে হলো যদি সত্যি সত্যি বগালেকের আশে পাশে টিনের ঘরের ভেতর একটি রাত কাঁটিয়ে দিতে পারতাম।
বগালেকের পানি ঘিরে এখানে পাড়ার সংখ্যা একটু বেশি। সাধারণত দুই চার কিলোমিটারের মধ্যে সড়কে মানুষ দেখা যায় না কিন্তু বগালেকে জনসংখ্যা বেশি। একসময় লোকে পান কারার জন্য বগালেকের পানি ব্যবহার করতো। এখন তা আর করে না। বগালেকে নামা বা গোসল করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু তারুণ্যকি তা মানে, কোন কোন ভাবে তারা নিষিদ্ধ কাজটা করতে চায়। দেখলাম কেউ কেউ অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে এসেছে। একজন আরেক জনকে ধাক্কা মেরে লেকের পানিতে ফেলে দিচ্ছে। এরমধেই দুই এক পাক সাঁতার কেটে নিচ্ছে। লেকের পাশে সেনা ক্যাম্প ফলে ঝামেলা এড়াতে দ্রুত আবার উঠে পড়ছে।
বগালেক নিয়ে অনেক মিথ চালু আছে, কেউ বলেন, লেকের পানি কখনো কমে যায় না। শীত গ্রীষ্মে সমান পানি থাকে। ধারণা করা হয়। আগ্নেয়গিরির মৃত জ্বালামুখ বা উল্কা পতনের ফলে এই লেক তৈরি হয়েছে। উপজাতীয়দের কেউ কেউ বললেন, দু তিন বছর পরপর একবার এই লেকের নীল পানি সম্পূর্ণ ঘোলা হয়ে যায়। আবার মাসখানেকের মধ্যে স্বচ্ছ নীল জল। এরকম ঘোলা পানি কেউ দেখেছে তার সন্ধান পাইনি। কিন্তু উপজাতীয় বাসিন্দারা জোর গলায় দাবি করলেন। বগালেকের মিঠা পানিতে মাছও আছে। তবে লেকের কোথাও কাউকে মাছ ধরতে দেখিনি।
বগালেক যেতে পথে পথে দেখা যায় ঝিড়ি ও ঝড়না। কোন কোন ঝড়নার পানি কলকল করে বয়ে যাচ্ছে কান পেতে শব্দ শোনা যায়। কোন কোন ঝড়না কখনো কখনো শুকিয়ে যায। তখন অন্য কোথাও বের হয় নতুন ঝড়না ধারা। এই এলাকার খাবার পানির উৎস প্রধানত এইসব ঝড়না ও ঝিড়ির পানি। পাহাড়ে আল্লাহতালার সৃষ্টির অপার রহস্য লুকিয়ে আছে। মানুষ তো থাকবে কিন্তু পানি ছাড়া মানুষ বাঁচবে কিভাবে সুতারং আল্লাহতালা সেই পানির উৎস পাহাড়ে পাহাড়ে সৃষ্টি করেছেন। ঝড়নাগুলোর পাশে দেখলাম ইস্কুটারের সারি। হাড়ি পাতিল কলস ডেক ডেকচিতে পানি ভরে স্কুটারে ভরে নিয়ে যাচ্ছে দূর দুরান্তে। সেনাবাহিনীর একটি পানির লড়িকেও দেখলাম পানি ভরছে এসব ঝড়না থেকে।
পাহাড়ের বাসিন্দারা সাধারণত পাহাড়ের কোন ক্ষতি করেনা। অকারণে গাছকাটে না। ঝোপঝাড় জঙ্গল থেকে খুজেনেয় আহারের ব্যবস্থা। এদের চাহিদাও খুব কম। আমরা অনেক সময় বলি কেরোসিন আর লবন চাই। লবন হয়তো চাই কিন্তু কেরোসিনের ব্যবহার খুব একটা নেই বললে চলে। আলো জ্বালাবার বিকল্প কি ব্যবস্থা আছে জানি না। কিন্তু তার যে খুব একটা প্রয়োজন আছে তা মনে হয়নি। সূর্যের আলো থাকতে থাকতে পাহাড়িরা খেয়ে নেই তারপর ঘুম। আবার খুব ভোড়ে উঠে খাদ্য ও জ্বালানির সন্ধান। ঢোলা ভর্তি করে নিয়ে আসে পেঁপে কলা, মাটির নিচের আলু কিংবা ওলকচু। এগুলোই খাবার, উপজাতীয়রা যে জুম চাষ করে সেখানে যে ধান হয় তার ভাত আঠালো । সামান্য পানি দিয়েই সে ভাত রান্না করা হয়। এটাও মানুষকে টিকিয়ে রাখার আল্লাহতালার ব্যবস্থা। পানি বেশি খরচ করলে তো চলবে না। পানির যে অভাব,এর মধ্যেই চলে পার্বত বাসিন্দদের জীবন ধারা। যাই হোক বগালেক থেকে ফেরার পথে একই রকম থ্রিল। পুরোনো পথ সেই রুমা বাজার সেই বান্দরবান। মাঝখানে আমরা দুরাত্রি থাকলাম চিম্বুক পাহাড়ে। বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রীঙ্গ। সেখানে আছে গোল ঘর। আগেরবার যখন গিয়েছিলাম। তখন সেখানে পানি ছিলো না। এখন চিম্বুক পাহাড়ের পাশে নতুন ঝড়না বেড়িয়েছে। সেখানে পাম্প বসিনে পানি তোলা হয় উপরে। সে পানি খেতেও পারেন অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন। সন্ধারপর পাহাড়ে আশ্চার্য নিরবতা নেমে আসে। মুক্ত বায়ু ধুলাবালি নেই সিনিগ্ধ হাওয়া একটি ঘারির হর্ণও নেই। সব শুনশান হয়ে যায়। চিম্বুক,বগালেক ভ্রমণ শেষে ফিরে আসি বান্দরবানে। সেখান থেকে ঢাকা। কিন্তু স্মৃতিতে রয়ে গেলো অবিশ্বাস ভ্রমণ আর বগালেক।