চলমান বিক্ষোভে ইরানের ভবিষ্যৎ বার্তা
|
৪ কার্তিক ১৪২৯ |
Wednesday, October 19, 2022
আমি যখন পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য ১৯৭৯ সালে ইরান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরি, তখন আমেরিকার এক দল প্রগতিশীলের সঙ্গে ইরানের বিপ্লব নিয়ে আমার অনভূতি এবং দেশটিতে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ উত্থান সম্পর্কে কথা বলি। তখন আমি যা বলেছিলাম, ইরানে রাজতন্ত্র হটানোর আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং তার ইসলামীকরণ করা হয়। আমি তখন এটাও বলেছিলাম, ‘ইসলামিক রিপাবলিক’- এই পরিভাষাটি পরস্পরবিরোধী। কোনো দেশ তার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি তথা রাষ্ট্রপতি দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ধারণাটি ইসলামের অভিভাবকত্বের ধারণার সঙ্গে বেমানান। তা ছাড়া আমি উল্লেখ করেছিলাম, আধুনিক পুঁজিবাদের সঙ্গে ইসলামী প্রজাতন্ত্র সাযুজ্যপূর্ণ নয়। যেমন সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ। অন্য অনেক ধর্মেও এর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ আধুনিক ব্যাংকিং সুদভিত্তিক। আপনাকে হয় ধর্মের শিক্ষা পরিবর্তন করতে হবে, যেটি খ্রিষ্টানরা করেছে। অথবা সুদকে অন্য নাম দিতে হবে, ইরান সেটাই করেছে। এ কারণে এবং আরও কিছু অসামঞ্জস্যের জন্য আমি তখন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম- ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বেশি দিন টিকবে না।
আমি স্বীকার করি, আমার সেই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হয়েছিল। ৪৩ বছর পরও ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র চলছে। তবে আমার বিশ্নেষণ একেবারে সঠিক ছিল না, তা নয়। আমি এখনও বলি, ‘ইসলামিক রিপাবলিক’- এই পরিভাষাটি পরস্পরবিরোধী এবং আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে বেমানান। তথাকথিত পশ্চিমা গণতন্ত্রে, যে ব্যবস্থা সম্পর্কে কার্ল মার্ক্স এক সময় বলেছিলেন, কয়েক বছর পরপর মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় শাসক শ্রেণির কোন গোষ্ঠী তাদের ব্যবহার করবে। ফলে ভোটাররা দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে- কোন দল কিংবা কোন ব্যক্তিকে ভোট দেবে। ভোট দিয়ে তারা প্রত্যাশা করে, একদিন তারা ভাগ্যবান হবে কিংবা তাদের অনেক উন্নতি ঘটবে। যদিও এসব প্রত্যাশা নির্বাচনের পরই বোঝা যায়, বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র পশ্চিমা গণতন্ত্র ধার করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে তারা বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতাকেও গ্রহণ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত তিনি এবং তাঁর পরিষদ গ্রহণ করবেন, যেখানে প্রেসিডেন্টও তাঁর অধীন।
প্রথম থেকেই ইরানে সর্বোচ্চ নেতার পরিষদ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তবে যারাই এ শাসনের বাইরে যায় তাদের নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা শায়েস্তা করার ব্যবস্থা বিদ্যমান। এমনকি এই শাসনের ব্যাপক সমর্থকও রয়েছে। বস্তুত ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র টিকে থাকার এটা এক কারণ। এ পদ্ধতি টিকে থাকার আরেকটি কারণ হলো, তাদের বিরোধী শক্তির মিত্র হলো পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরায়েল। পশ্চিমা বিশ্ব এবং তার মিত্ররা ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র এই শত্রুতাকে নিজেদের উপকারার্থে ব্যবহার করেছে।
এ বছরের জুলাই মাসে ইরানের অর্থনীতির সম্ভাবনা নিয়ে ইরানের একটি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, ২০২৩ সালে ইরানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হার দেখা যাচ্ছে, তার খুব খারাপ অবস্থা স্পষ্ট। ২০২২ সালের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ম্ফীতির হার ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আমি বলেছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও ইরানের অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। ইরানের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক সংকট থাকা সত্ত্বেও তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বছরের পর বছর ধরে অনেক ইরানি এসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এ আশায়, সেখানে সমৃদ্ধি আসবে। কিন্তু সব সময় এটা প্রমাণিত- নির্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্বাচন আসলে প্রহসন। ইরানে ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও প্রমাণ করেছে- ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ পরিভাষাটি পরস্পরবিরোধী। কারণ ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ আসলে প্রজাতন্ত্র নয়। একজন ব্যক্তি ও তাঁর সমমনাদের দ্বারাই এটি পরিচালিত।
এখন ইরানে তরুণ প্রজন্মের যে বিক্ষোভ চলছে, তাতে আরও স্পষ্ট হয়েছে, সেখানকার ইসলামী প্রজাতন্ত্র আধুনিক পুঁজিবাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সেখানে একটা স্ম্ফুলিঙ্গের দরকার ছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মাহসা আমিনির মৃত্যু এর জন্ম দিয়েছে। যদিও এ বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে এটি চলমান; তার পরও এ আন্দোলন বলা চলে বিচ্ছিন্ন এবং নেতৃত্বহীন। অবশ্য এটা ঠিক, এ আন্দোলন ইরানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা বার্তা দিচ্ছে।
আমি সব সময় এ তথ্য জেনে আসছি, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও পশ্চিমাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে ভালো কেউ নেই। পশ্চিমা মানে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্র বিশেষ করে ইসরায়েল ও সৌদি আরব। প্রশ্ন হলো, এদের মধ্যে বেশি খারাপ কে বা বেশি বিপজ্জনক কে? কারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নৃশংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে? সর্বোপরি কে বিশ্বের জন্য বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে? আপনি যখন এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজবেন, তখন আপনাকে মূল দৃষ্টি দিতে হবে একজনের দিকে, তবে আরেকজনকে দৃষ্টির আড়াল করা যাবে না।
শশান ফয়েজমানেশ: ইমেরিটাস অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, ফ্রেসনো; কাউন্টারপাঞ্চ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক