খেলা যেন হয় শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ
|
২৫ কার্তিক ১৪২৯ |
Wednesday, November 9, 2022
মাজহার মান্নান : মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব সংঘাত এড়াতেই বহু বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসে প্রচলন হয়েছিলো খেলার। তখন মানুষ তাদের শারীরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য সরাসরি দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়তো। চরম প্রতিযোগিতায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা মরিয়া হয়ে উঠতো। কিন্তু একটি সভ্য সমাজে তো এটা চলতে পারে না। গ্রিসে সভ্যতার সূচনা হয়েছিলো। আর এই সভ্যতার একটি বড় ফসল ছিল খেলার মাধ্যমে কোনো প্রতিযোগিতা করা। চরম প্রতিযোগিতায় ভরপুর কিন্তু শান্তিপূর্ণ আর নিরপেক্ষতার চাদরে আবৃত সেই খেলার প্রচলন আজও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। খেলা যেহেতু একটি চরম প্রতিযোগিতার বিষয় তাই এটি শর্তহীন নয়। খেলার জন্য কতকগুলো শর্ত বা নিয়ম রয়েছে। এই শর্ত বা নিয়ম ভঙ্গ করলে খেলোয়ারদের শাস্তি ভোগ করতে হয়। খেলার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য একজন নিরপেক্ষ রেফারিও প্রয়োজন হয়। রেফারি উভয় দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করেন এবং নিরপেক্ষভাবে খেলার নিয়মগুলো প্রয়োগ করে থাকেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে খেলা শব্দটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মুখ থেকে। এই খেলাটি অন্যান্য সাধারণ খেলার মতো নয়। এটি একটি রাজনৈতিক খেলা আর এই খেলা ভয়ংকর এবং দানবীয় রূপ নিতে পারে। আবার এই খেলাটি শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষও হতে পারে। জনগণ সব সময় শান্তিপূর্ণ খেলার পক্ষে থেকেছে। কিন্তু বড় দলগুলোর নেতাদের খেলার আওয়াজ যেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে তাতে অস্থিরতার একটি পূর্বাভাস রয়েছে। যিনি এই খেলাটির মধ্যস্থতা করবেন তিনি হলেন নির্বাচন কমিশন। এই কমিশনের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর কতটুকু আস্থা রয়েছে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন দেখছি না। কতটুকু চাপমুক্ত থেকে রেফারি ( নির্বাচন কমিশন) খেলা পরিচালোনা করতে পারবেন সেটা সময় বলে দিবে। তবে খুব একটা বেশি সময় রেফারির হাতে নেই। ২০২৩ সাল জুড়ে নির্বাচনী ডামাডোল চলবে দেশে। একই সঙ্গে ২০২৩ সালটি আমাদের জন্য বহুমুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। ২০২৩ সালে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের একটি পূর্বাভাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার নির্মম শিকার আমরা হতে পারি।
রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধসহ সারা বিশ্ব আজ এক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কোনো যুদ্ধে না জড়ালেও যুদ্ধের প্রভাবমুক্ত আমরা থাকতে পারবো না। বিপদ সংকেত আমাদের জন্য রয়েছে। আর সেটাকে অবশ্যই মাথায় রেখেই সকল খেলা খেলতে হবে। গায়ের জোরে খেলে বিপদকে আরো ত্বরান্বিত করার ফল শুভ হবে বলে মনে হয় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বেহাল দশায় রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটও দিনে দিনে ঘনীভ‚ত হচ্ছে। তেল এবং নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। ডলারের দামে লাগাম দেয়া আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুমাত্রিক সমস্যার আবর্তে এখন দেশ। বেকার সমস্যার কথা বললেতো গা শিউরে ওঠার মতো অবস্থা। যাহোক সমস্যামুক্ত কোনো দেশ নেই। সমস্যাকে মোকাবিলা করেই আগাতে হবে। তবে কৃত্রিম সমস্যা সৃষ্টি করে সেটাকে মোকাবিলা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর খেলা শব্দটি কি বার্তা দিচ্ছে সেটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খেলা হবে আন্দোলনে, নির্বাচনে। আর এই দুটি ম্যাচের ফয়সালা হবে রাজপথে। এখানে দুটি খেলার ক্রনোলজিক্যাল ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রথম খেলাটি হবে আন্দোলনে।
আমাদের দেশে আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ ইতিহাসটা খুব পাকাপোক্ত নয়। আন্দোলনের সাথে চরম নৈরাজ্য, জ্বালাও পোড়াও, আর সংঘাতের একটি নিবিড় যোগসূত্র দৃশ্যমান। কিন্তু জনগণ সব সময় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই চেয়েছে যদিও তারা সেটা পায়নি। আন্দোলনে আর্থিক ক্ষতিও কম হয়নি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক আমরা বহুবার শুনেছি কিন্তু খুব অল্প সময়ে সেটা সংঘাতে রূপ নেয়। দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের উদ্দেশ্যটা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী এবং সাংঘর্ষিক। বিএনপি আন্দোলন করবে নিরপেক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আর আওয়ামী লীগ আন্দোলন করবে সেটা যেন কখনই দেশে না আসে সেজন্য। রাজপথের এই প্রীতি ম্যাচে কতটুকু প্রীতি শেষ পর্যন্ত থাকবে সেটাই বড় প্রশ্ন। ওবায়দুল কাদের অবশ্য জনগণকে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভোট চুরি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে খেলা হবে।
খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, প্রহসনমূলক নির্বাচনের বিরুদ্ধে। ওবায়দুল কাদেরের শেষের এই কথা গুলোর সঙ্গে বিএনপির বড় নেতাদের কথা মিলে যাচ্ছে। তারাও প্রহসনমূলক নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। তাহলে তো আর টেনশন থাকলো না জনগণের। আন্দোলনটি একটি সুন্দর প্রীতি ম্যাচে রূপ নিতে পারে। কিন্তু এগুলি কি শুধু কথার কথা! রাজনৈতিক মাঠ গরম রাখার কথা! নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার কথা? রাজনৈতিক দলগুলো বহুমাত্রিক কৌশল নিয়ে থাকে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু কৌশলের ফাঁদটি যত গঠনমূলক হবে জনগণ ততোটা স্বস্তি পাবে। আর যদি সেটা গঠনমূলক না হয় তবে জনগণের দুঃখের শেষ নেই। বিএনপি কয়েকটি বিভাগীয় সম্মেলন করেছে। তাদের অভিযোগ সরকার পরিবহন ধর্মঘট করে তাদের নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপির এই অভিযোগকে অস্বীকার করেছে। দুটি বড় দলই চাচ্ছে কে কত বেশি জনগণ নিয়ে সমাবেশ করতে পারে। সমাবেশে বেশি লোক হলেই যে ভোটের হিসাব বদলে যাবে এমনটি নয়। জনগণ কাকে বেছে নিবে সেটা তারাই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। জনগণের শুধু চাওয়া একটি শান্তিপূর্ণ এবং সংঘাতমুক্ত নির্বাচন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল আমরা খুব কমই এমন সংঘাতমুক্ত নির্বাচন উপহার পেয়েছি। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে নানামুখী জটিলতা দৃশ্যমান। সরকারি দল এবং তাদের অনুসারীরা ইভিএমে ভোট চায়, কিন্তু বিরোধী শিবির ইভিএমের বিপক্ষে। এটা নিয়েও তো একটি খেলা হবে মনে হচ্ছে। আন্দোলনের খেলাটিই পরবর্তী খেলার (নির্বাচন) ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। প্রথম খেলায় বিজয়ীরা পরবর্তী খেলায় সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। যাহোক, খেলা পরিচালনাকারীর ভ‚মিকাটি কি হবে সেটাই বড় প্রশ্ন। আমি আগেই বলেছি খেলার কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত হলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করা এবং নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী থাকা। খেলার মাঠে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যই নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী রেফারি প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশন হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গাইবান্ধায় তার একটি নজিরও জনগণ দেখলো। তবে চ‚ড়ান্তভাবে কমিশন কতটা ভালো নির্বাচন উপহার দিবে সেটাই দেখার বিষয়। নির্বাচনী সহিংসতার কারণে নির্বাচন কমিশনের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ভোটাররা ভোট কেন্দ্র বিমুখ হয়ে পড়ছেন দিন দিন। সাধারণ জনগণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের ভোটটি দিতে চায়, কিন্তু তারা যখন সহিংসতার শিকার হয় তখন আর ভোট কেন্দ্রে যেতে সাহস করে না বা ভোটের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এর ফলে নির্বাচন কমিশনসহ পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরাজয় মেনে নেয়ার প্রবণতা খুব কম। এটার মূল কারণ হচ্ছে রাজনীতি আজ প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। রুট লেভেল থেকে রাজনীতি না করেই দলে বড় বড় পদ পেয়ে যাওয়া আজ নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে চলেছে। সুস্থ রাজনীতির ফসল জনগণ পায়। দেশ দুনীতিমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং গণতান্ত্রিক হয়। খেলা যেটাই হোক, জনগণের যেন জয় হয়- সেটাই কাম্য। শুধু খেলা হলেই হবে না, খেলার একটি ইতিবাচক ফল জনগণ দেখতে চায়। জনগণ এমনিতেই নানামুখী সমস্যায় আছে। তারা আর কোন ভয়ংকর রাজনৈতিক খেলা দেখতে চায় না। রাজনৈতিক অস্তিত্বের লড়াইটি হোক জনগণের কল্যাণে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট