অগ্নিকাণ্ডে বছরে ক্ষতি ১৬১ কোটি টাকা
|
২৫ কার্তিক ১৪২৯ |
Wednesday, November 9, 2022
স্টাফ রিপোর্টার : প্রতিবছর দেশে সংঘটিত মোট অগ্নিকাণ্ডের প্রায় আট হাজারের উৎস বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। যার অন্যতম কারণ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। এসব অগ্নিকাণ্ডে বছরে আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় গড়ে ১৬১ কোটি টাকার বেশি। আর বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অগ্নিকাণ্ড প্রায় ৩৮ শতাংশ। এর পরই আছে চুলা ও বিড়ি-সিগারেটের আগুন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবন নির্মাণের সময় ঠিকাদার, ডেভেলপার, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ক্যাটাগরির বৈদ্যুতিক তার, ট্রান্সমিটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারের সঠিক মান যাচাই-বাছাই, পর্যালোচনা করা হয় না। অনেকেই খরচ কমাতে কম দামের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করেন। ভবনের নকশায় ত্রুটি, ইচ্ছামতো বিদ্যুতের সংযোগ, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের নকশা, যথাযথ স্থানে সংযোগ স্থাপন না করাসহ নানান কারণে বৈদ্যুতিক গোলযোগে অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্ঘটনায় ক্ষতি কমালেও দুর্ঘটনা কমছে না। এজন্য প্রয়োজন ভালো মানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো।
বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ধরন ও তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিস বলছে, অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। অর্থাৎ, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্টসার্কিট হয়ে ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও আগুন লাগার প্রধান কারণ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। এছাড়া আগুন লাগার আরেকটি বড় কারণ বিড়ি-সিগারেট ও রান্নার চুলা।
গত পাঁচ বছরের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য বলছে, বছরে গড়ে ৩৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের কারণ শর্টসার্কিট। এর পরই রয়েছে রান্নার চুলা। ২০২১ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ড ৩৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২০ সালেও বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই (৩৬.৬৮ শতাংশ)। আগের দুই বছর অর্থাৎ, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগে অগ্নিকাণ্ড ৩৯ শতাংশ। ২০১৭ সালে ছিল ৩৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বৈদ্যুতিক গোলযোগের ফলে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানিসহ বিপুল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে বছরজুড়ে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যমতে, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে লাগা আগুনে বছরে গড়ে ক্ষতি ১৬১ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ২৮৬ টাকা। এরমধ্যে ২০২১ সালে ৭ হাজার ৯৫৫টি বৈদ্যুতিক গোলযোগে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি ১৩১ কোটি ৭ লাখ ৪২ হাজার ৯৫১ টাকা, ২০২০ সালে ৭ হাজার ৭২৯টি বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুনে পুড়ে ক্ষতি ১০১ কোটি ২৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৫১, ২০১৯ সালে ৮ হাজার ৬৪৪টি দুর্ঘটনায় ক্ষতি ২৩২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৬, ২০১৮ সালে ৭ হাজার ৮২৫টি দুর্ঘটনায় ক্ষতি ২০৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৩৭৫ ও ২০১৭ সালে ৬ হাজার ৬৯০টি বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় ১৩৭ কোটি ২ লাখ ৭০ হাজার ৩৪১ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জানা যায়, বৈদ্যুতিক তার তৈরির প্রধান কাঁচামাল তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক। তামার তারের মান ভালো, দামও বেশি। অ্যালুমিনিয়ামের তারের দাম তুলনামূলক কম। তবে বিশেষ কিছু পর্বে অ্যালুমিনিয়ামের তার ব্যবহার হয়। কপার ও প্লাস্টিকের স্থায়িত্ব সমান করতে হলে তারের জন্য বিশেষ মানের পাস্টিক কাঁচামাল ব্যবহার করতে হয়। নইলে আগেই ইন্সুলেশন নষ্ট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। বৈদ্যুতিক তার, কপার ও অ্যালুমিনিয়াম ওয়্যার দিয়ে তৈরি ফ্যান, মটর, ট্রান্সমিটারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র কপারওয়্যার দিয়ে তৈরি। সঠিক মানের কপারওয়্যার ব্যবহার না করায় তার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম জনজীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
এ বিষয়ে পুরান ঢাকার নবাবপুরের ব্যবসায়ী রাসেল সরকার বলেন, তার কিনতে এসে অনেকে প্রথমেই কম দামি তার ও বৈদ্যুতিক পণ্য খোঁজেন। অনেকে খরচ বাঁচানোর জন্য কম দামে নকল পণ্যই কেনেন। অনেক অসাধু কোম্পানি ও ব্যবসায়ী এসব নকল পণ্য তৈরি করে। খোরশেদ আলম নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, নকল পণ্যের বিক্রি বেশি। কম দামে কিনে এসব বৈদ্যুতিক পণ্যই বড় বড় ভবনে লাগানো হচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে কোম্পানিগুলোও বলছে, বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারের মধ্য দিয়ে তাপ ও তড়িৎ সঞ্চালন শক্তি ভালো রাখা। এজন্য প্রয়োজন ভালো কভারের। বিআরবি ক্যাবলসের সহকারী মার্কেটিং অফিসার মো. সিয়াম রহমান বলেন, তারের কভারের তাপ ও তড়িৎ সঞ্চালন শক্তি ভালো থাকলে সহজে বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়। তাপ ও তড়িৎ সঞ্চালন শক্তি ভালো না হলে আগুন লাগতে পারে। অনেকে তারগুলোর তাপ ও তড়িৎ সঞ্চালন শক্তি যাচাই না করেই বাজার থেকে কম দামে নিুমানের তার কেনেন। এসব তার যেখানে ব্যবহার করা হয় সেখানেই ঝুঁকি থাকে।
বৈদ্যুতিক গোলযোগের ফলে ঘটা অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আইনাল হক বলেন, ভবনের নকশা ঠিকমতো হয় না। একটা ভবন করার পরে ইচ্ছামতো লাইন টেনে নেয়। এতে অনেক সময় নিম্নমানের তার ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ভবনে যত্রতত্র ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎপ্রবাহ ব্যাঘাত ঘটার ফলেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ইলেক্ট্রনিক নকশা প্রণয়নেও অনেক সময় সঠিক পন্থা অবলম্বন করা হয় না। মানুষের সচেতনতা দরকার। বিল্ডিং কোড আইন থাকলেও সেটা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না সেটিও দেখতে হবে। নিম্নমানের তার, মানহীন ইলেক্ট্রিক সরঞ্জামাদি, মানুষের অসাবধানতা ও অসচেতনতার ফলে অগ্নিকাণ্ড ঘটে বলে মনে করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, নিম্নমানের তার ব্যবহারের পাশাপাশি মানহীন ইলেক্ট্রিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের ফলেই বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। পাশাপাশি মানুষের অসাবধানতা বা অসচেতনতার ফলেও আগুন লাগে। সবার আগে প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে করণীয় কী সে বিষয়ে আমরা প্রশিক্ষণ দিলেও মানুষের সচেতনতা ছাড়া এ ধরনের দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়।