সুশাসন গণমাধ্যম এবং কিছু কথা
|
২৩ পৌষ ১৪২৯ |
Friday, January 6, 2023
মীর আব্দুল আলীম :
সুশাসনের অর্থ নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকর শাসন। সুশাসনের জন্য রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণ আচরণ, দুর্নীতি ও নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ এবং নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য। আর সুশাসনের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যম আর স্বাধীন বিচার বিভাগ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। স্বাধীন বিচার বিভাগ না থাকলে বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পায়, যা কোনো রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। কোনো রাষ্ট্রে সরকারের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়। সুশাসনের বড় অন্তরায় দুর্নীতি। আর দুর্নীতির রাহুগ্রাস রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে। আমাদের দেশে অব্যাহত দুর্নীতি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয় হয়, বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এজন্য জনসচেতনতা অপরিহার্য। জনগণ সচেতন না হলে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে।
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাচর্চা সুশাসনের অন্তরায়। গণতান্ত্রিকচর্চা, মূল্যবোধের বিকাশ, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন। আর সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে প্রয়োজন শক্তিশালী গণমাধ্যম। দুঃখজনক হল, দেশের গণমাধ্যম কখনই স্বাধীন ছিল না। শাসকগোষ্ঠী বারবার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। সমাজের অসঙ্গতি দূর করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিহার্য। সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সরকার ও বিরোধী দলের পথনির্দেশনা তৈরি করে দেয় সংবাদপত্র। এর কারিগর হল সাংবাদিক সমাজ।
বর্তমানে ‘সুশাসন’ ও ‘গণমাধ্যম’ এ দুটি বিষয় পরস্পর গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও আইনের শাসনকে কেউ কেউ বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ¢ হিসেবে তাদের সমুচিত জবাব দেয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকা মোটেও জোরালো নয়। উল্টো কোনো কোনো গণমাধ্যমকর্মী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
এদেশে কিছু কিছু সংবাদপত্র ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, অদূরদর্শী একপেশে খবর ও পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য নৈতিকতাবিবর্জিত সংবাদ প্রচার করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে কখনও কখনও। অনেক সময় মিডিয়া ট্রায়ালের ফলে বিচারক ও বিচারপ্রার্থী জনগণ বিব্রত হয়, যা অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। তবুও বলতে হয়- এ দেশে সুশাসন যতটুকু প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, এজন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অন্যতম। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর গভীর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে।
আরেকটি বিষয় হল, সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নয়। জনস্বার্থে সবকিছু অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তুলে ধরার স্বাধীনতাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। সাংবাদিকতার মহান পেশাকে সমুজ্জ্বল রাখতে সব সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করবেন, দেশের বিদ্যমান সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ এবং প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করে জনগণের আস্থা অর্জন করবেন।
সমাজে বিদ্যমান নানাবিধ অসঙ্গতি, অন্যায়-অবিচার, সাফল্য-ব্যর্থতা সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এতে আপামর জনসাধারণের পাশাপাশি সরকার ও দেশ উপকৃত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশে সংবাদ এখন আর নিছক কোনো তথ্য নয়; বরং বিনোদন ও জ্ঞানের ভাণ্ডার।পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার।
অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে তাই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও জাতি গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখা জরুরি। গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই সে ভূমিকা যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট। অনেকে আবার নিজস্বার্থে দেশপ্রেমের চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে থাকেন। সংবাদমাধ্যম এবং গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে এটি মোটেও কম্য নয়।
‘সুশাসন’ বা গুড গভর্নেন্স মূলত একটি পশ্চিমা অভিধা। সুশাসন প্রতিষ্ঠা দেশের উন্নয়ন, দেশের মানুষের সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম ভিত্তি। সুশাসনের কোনো সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা নেই। সুশাসন মানে ভালোভাবে দেশ পরিচালনা- বিষয়টিকে এভাবে সরলীকরণ করা যেতে পারে। যেমন- স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় বহুমুখী অংশীদারিত্ব, মানবাধিকার ও আইনের শাসন, দেশ পরিচালনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে মানুষের অংশগ্রহণ, রাজনীতিতে নানা মতের চর্চা, একটি দক্ষ ও কার্যকর সরকারি খাত, শিক্ষা, তথ্য ও অন্যান্য জ্ঞান আহরণের সুযোগ, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, সমতা ও ন্যায়বিচার, দায়িত্ববোধ, ঐক্য ও মূল্যবোধ ইত্যাদি।
দেশের সার্বিক উন্নয়ন টেকসই করতে আইনের শাসনের ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের কার্যকারিতা, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ, দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সহিংসতার অনুপস্থিতি ও নিয়মবিধির প্রয়োগ সুশাসনের সূচক। এর ভিন্নতা হলেই দেশে সুশাসন থাকে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার নানা দিকের মধ্যে দুটি দিক অন্যতম। সরকার ও আমলাতন্ত্র, যারা দেশ শাসন করে; অন্যপ্রান্তে থাকে দেশের মানুষ। দেশের জনগণই দেশের প্রকৃত মালিক। এ দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হলেই সমস্যা বাধে।
দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যদওি কোভডি এবং ইউক্রনে যুদ্ধরে কারনে বশ্বিমন্দার প্রভাব বাংলাদশেে পড়ছে।ে এর পরও বাংলাদেশ এক সময় হবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা কোরিয়ার মতো সেই স্বপ্ন দেখি আমরা। দেশে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, রকেট ট্রেন ইত্যাদি হয়ছে,ে হচ্ছে। দেশের মানুষের আয় বেড়েছে; এরপরও সরকারের সঙ্গে জনগণের ব্যবধান নেই, বলা যাবে না। আমাদের দেশ খুব সুশাসিত তাও বলা যাবে না। দেশে একবারেই সুশাসন নেই তাও নয়। যেটুকু ফারাক আছে, তা কমিয়ে আনা সম্ভব। সরকার ও আমলাতন্ত্র যদি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। দেশের মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকলে সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখনই দেশের মানুষের কষ্ট বাড়ে। তাতে দেশের অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হয়, বিঘ্নিত হয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রক্রিয়া।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সুশাসন পরিস্থিতি নেতিবাচক। এ অবস্থা আমাদের কাম্য হতে পারে না। উপরোক্ত সূচকগুলোর পজিটিভ দিক তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যম কতটা ভূমিকা রাখতে পারছে? গণমাধ্যমের ভূমিকা যতটুকু, তা সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপরিহার্য। একটি রাষ্ট্র যখন এসব নিশ্চিত করতে পারে, তখনই বলা যায়- গণতন্ত্র গুণগত ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হলে গণমাধ্যমকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের দেশে এসব স্বাধীনতা খর্ব হলে অনেক সময় সংবাদপত্রের ভূমিকা জোরালো থাকে না। কোনো কোনো গণমাধ্যম পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকায় থাকে। সাংবাদিকদের অনৈক্য এর অন্যতম কারণ। সাংবাদিকদের ঐক্যে ও ভ্রাতৃত্বের অভাবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন ঘটে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও অপরিহার্য। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্রও অর্থহীন। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সবকিছুর পরও বলতেই হয়, এদেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে মানুষকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। বস্তুত সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সময়োপযোগী সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে নিরন্তর সহযোগিতা করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এ ক্ষেত্রে আরও জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশিত।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।