মশার জোট ভোটে চোট!
|
১২ আষাঢ় ১৪৩০ |
Monday, June 26, 2023
মীর আব্দুল আলীম : মোটেও নয় মশকরা, যায় না মশা বশ করা! মশা যদি বসকরা না যায়, ভোটের আগে জনগন বস হবে কি? কোনভাবেই মশাদের বশ করতে পারছে না রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। আর মশা দমন না করতে পারলে আগত সংসদ নির্বাচনের ভোটে চোট পারবে। আকারে ছোট হলেও অতি ক্ষমতাধর এই মশা! আগেও মশা এদেমে ভোটে প্রভাব ফেলেছে। তাই সরকারও মশা এবং ডেঙ্গুরোধে বেশ স”েষ্ট আছে। বাংলা প্রবাদে মশা মারতে কামান দাগানোর কথা বলা আছে মজার ছলে। এখন বোধহয় কামান দাগিয়েও মশাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মশা দমনে কামানের গোলার মান যদি খারাপ হয়, মশারা তবে বশে আসবে কি করে? মশার ঔষধে নাকি ভেজাল। তাই মশা কোন কিছু তোয়াক্কা না করেজনতার গায়ে হুল ফুটাচ্ছে। ক্ষুদ্র এ প্রাণী আমাদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। একদিকে মশার ভনভনানি, আরেক দিকে প্রাণঘাতী মশাবাহী ডেঙ্গুর ভয় আমাদের ঘুম সত্যিই হারাম করে দিয়েছে। জনগনের ঘুম হারাম হলে ভয় আছে। জনগন আবার সরকারের ঘুম হারাম করে দিতে পারে।
রাগঢাক না রেখেই বলতে হয়, মশককুল রাজধানীতে যেন রামরাজত্ব কায়েম করেছে। এ মশকবাহিনী দুই সিটি করপোরেশনের সুনামে হুল ফুটাচ্ছে! যখন লিখছি তখনো মশার দল হুল ফুটাচ্ছে পায়ে, মুখে, গালে। এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক। সৌখিন ফুলের টবে, এসির জমে থাকা পানিতে, এমনকি যেকোনো পাত্রে যদি কয়েকদিনের পানি থাকে সেখানেও চলে এডিস মশার জন্মোৎসব। এ মশার কামড়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের প্রাণ গেছে। তাই হাইকোর্টকেও তো মাথা ঘামাতে হচ্ছে। এ বছর রাজধানীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় মশার উৎপাত বেশিই। অনেকে মনে করেন, সিটি করপোরেশন সচেষ্ট হলে মশার প্রকোপ কমে আসবে ক্রমশ।
প্রশ্ন হলো, মশা নির্মূলে কি করছে দুই সিটি করপোরেশন? ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণে মশা নিধনের জন্য ১ হাজারের ওপর মশকনিধন শ্রমিক কর্মরত আছে। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচ/ছয় জন কর্মী আছে বলে পত্রিকায় জেনেছি, যাদের কাজ শুধু মশার ওষুধ ছিটানো। প্রতি বছর মশা নির্মূলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পায় দুই সিটি করপোরেশন। এত কিছুর পরও রাজধানীতে দিন দিন মশার প্রকোপ বাড়ছে কেন? এই বিপুল জনবল আর বড়ো অঙ্কের অর্থের সঠিক ব্যবহার হলে তো নগরীতে এভাবে মশা থাকার কথা নয়। সমস্যা আছে অনেক। জেনেছি, লোকবল আছে, ওষুধ আছে, তবে সে ওষুধ ঠিকঠাকমতো ছিটায় কি না—তার মনিটরিংয়ে অবহেলা আছে। এত লোক সারা বছর কাজ করলে, এত অর্থ ব্যয় করলে তো নগরীতে মশা জন্মানোর কথা নয়। মূল কথা হলো যেখানে মশারা জন্ম নেয়, সেখানে ওষুধ পড়েই না।
মশা নিধনের জন্য অর্থ জনবলের পাশাপাশি মনিটরিং দরকার। এর পাশাপাশি নগরবাসীর উচিত নগর বসবাসযোগ্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। লক্ষ্য করা গেছে, সুনির্দিষ্ট কিছু অভিজাত এলাকা ছাড়া কোথাও ক্রাশ প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন কম, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত মহানগরীতে নাগরিকদের সব সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তি একই মানদণ্ডে বিচার্য হওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখা উচিত বিশাল বিশাল অট্টালিকার বাইরেও এ মহানগরীতে প্রায় চল্লিশ লাখ লোক বস্তিতে বসবাস করে। সামর্থ্যহীন এ লোকগুলোর জীবন-জীবিকার দায়ভার বহন করাই যখন কষ্টসাধ্য, সেক্ষেত্রে মশার উপদ্রব থেকে নিজেকে রক্ষার বিকল্প তাদের আর কীই বা থাকতে পারে।
ডিসিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লিকুইড ইনসেক্টিসাইড নামক কীটনাশক দিয়ে নগরীতে উড়ন্ত মশা নিধনের বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে তারা। কিন্তু আমরা এখনো তার আলামত দেখছি না। বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আবদ্ধ ডোবানালা ও ড্রেনগুলোয় মশার বিস্তার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
কর্মসূচি বাস্তবায়নে ডিসিসির আরো জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, মশা নিধনের ক্ষেত্রে রয়েছে জবাবদিহিতারও অভাব। মশা দমন করতে হলে মশার প্রজনন ক্ষেত্রের দিকে সর্বাগ্রে দৃষ্টি দিতে হবে। গোটা শহর কার্যত ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে আছে। রয়েছে মাইলের পর মাইল খোলা নর্দমা। দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ৩ হাজার বিঘা ময়লা ফেলার জায়গা রয়েছে। এসব জায়গায় ফেলা ময়লা ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। ময়লা ফেলার স্থানগুলো মশা প্রজননের একেকটা ‘উৎকৃষ্ট’ ক্ষেত্র। খোলা নর্দমাগুলোও যথাসময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। মশার বংশবিস্তারে নর্দমাগুলোর বড়ো রকমের ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় তিন হাজার বিঘা জলাশয় রয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি জলাশয়ই ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পূর্ণ। এগুলোও মশার উৎস হিসেবে কাজ করছে। মশার প্রজনন স্থলসমূহ অবারিত ও উন্মুক্ত রেখে মশা দমন ও নিধনে সফল হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না।
সুতরাং প্রজনন ও উৎসস্থলেই মশার বংশ ধ্বংস করতে হবে। আবর্জনা দ্রুত অপসারণ করতে হবে। আবর্জনা ফেলার জায়গাগুলো সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ঐসব জায়গায় মশার জন্মাতে না পারে। খোলা নর্দমাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে এবং নিয়মিত ওষুধ দিতে হবে, যাতে সেখানে মশা জন্মাতে না পারে। একইভাবে জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, নিয়মিত ওষুধ ছিটিয়ে মশার লার্ভা মুক্ত করতে হবে। উেস মশা দমন ও নিধন না করে উড়ন্ত মশা দমন ও নিধন কার্যক্রম চালিয়ে ঢাকাকে মশামুক্ত করা যাবে না।
@ লেখক : সেক্রেটারী জেনারেল- কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ, চেয়ারপার্সন (পরিবেশ) - লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (৩১৫ এ-১)।