নিরপেক্ষ নির্বাচনের জিকির : রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার ফিকির
|
২৭ কার্তিক ১৪৩০ |
Saturday, November 11, 2023
মীর আব্দুল আলীম
সবাই নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। সাবাই যে কোনোভাবে নির্বাচনে জিততে চায়। সবাই রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা চায়। কেউ আমেরিকা, কেউ আবার চীন ভারতের উপর ভর করে মসনদ চায়। ছোটখাটো দলগুলোর বড় দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার স্বাদ গ্রহন করতে চায়। সবার কথা হলো- “আমার চাই ভাই রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা”। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদ, ইসলামী ঐক্যজোট ছোটবড় সবাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। সবারর মুখেই রাতদিন নিরপেক্ষ নির্বাচন জিকির; আর অন্তরে পুরোটাই ক্ষমতার ফিকির। প্রশ্ন হলো এদেশে হাতেগোণা ছাড়া কোন সরকারের সময় কয়’টা নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে? অনিরপেক্ষ নির্বাচনের সংখ্যা গুণে বলা মুশকিল!
আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে সবাই এভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচনেরই বুলি আউড়াচ্ছে। আর তলে তলে বহিশক্তির সাথে সখ্যতা, দৌড় ঝাঁপ চলছে পুরোটা। দেশের কি হবে সেটা না; দেশ গোল্লায় যাবে যাক, কিভাবে পরাশক্তির স্বার্থ রক্ষায় তোয়াজ চলে তা বেশ লক্ষ করছি আমরা। কেউ বলছে ওমক দল ভারতের কাছে দেশ বেঁচে দিচ্ছে, আবার আরেক দল বলছে আমরিকাকে কানভারী করে দেশ ধ্বংস করছে, কেউ বলছে ওমক দল দেশটাকে তালেবান, আফগান বানাতে চায়। এসব ভাবনায় দেশ প্রীতি দেখি না। আসলে দেশে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
যাই হোক সবাই যেহেতু নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়; নির্বাচন নিরপেক্ষ হবেই বলে ধরে নিতে হয়। সবার চাওয়ার লক্ষণে নির্বাচন নিরপেক্ষ না হওয়ার সুযোগও নাই। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়; সরকার দল আওয়ামী লীগও জোড়গলায় বলছে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। বিদেশী প্রভু বন্ধু, দেশ, সংস্থা সবাই এক যোগে নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না কেন? সবাই যখন নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় তাহলে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবেই।
বিজ্ঞাপন
সবসময়, সবাই নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন কি আদৌ হয়? বিএনপির সময়ে, জাতীয় পার্টির সময়ের নির্বাচনও আমরা দেখেছি। তখনো নির্বাচন অনেক প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েরও নির্বাচন নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দিনের ভোট, রাতের ভোট, ভোট লুটের গল্প শুনেছি অনেক।
জন্মের পর থেকেই ভোট চুরির কথা শুনছি। তবে সাধারণ জনগণ মনে প্রাণে নিরপেক্ষ নির্বাচনেই প্রত্যাশা করে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এমন বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে দেশের জনগণ। তবে নির্বাচন নিয়ে ভয় সবার মনে। নির্বাচন নিয়ে এত ভয় কেন? সবসময়ই নির্বাচনের ব্যাপারে সবার একই চাওয়া থাকে। কাজে কামে উল্টো দেখি মাঝে মাঝে। এখানেই যত ভয়; আগামী নির্বাচনে কী জানি কী হয়!
বিজ্ঞাপন
এবার নির্বাচনে কি হবে? সরকার দরের নেতারা বলছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ভিনদেশী রাষ্ট্রের প্রভুদের উপরে ভর করেছে, তারা ভাবছে তাদের চাপে নির্বাচন বুঝি অবাধ নিরপেক্ষ হরবে। ভাবছে হয়তো যার ভোট সেই দিতে পারবে এবার। এবার বুঝি ক্ষমত্যাচ্যুত হবে সরকার। বিগত (২০১৮) নির্বাচনের ব্যাপারেও কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ প্রবল ছিল, তখনও নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ ছিলো বিরোধীদলগুলোর। ২০১৮ সালে একাদশ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার নির্বাচনী জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় লাভ করেছে। যেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার নির্বাচনী জোট জয়ী হয়েছে ৭টি আসনে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসনে জয়লাভ করে নিরাপদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে। তবে বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করায় এই নির্বাচনটি বেশ বিতর্কিত ছিল। দশম নির্বাচন বর্জনের ফলে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। সব মিলিয়ে আগত সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
কথা বললে অনেক কি বলতে হবে। আমাদের দেখা মতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শাহাবুদ্দিন সাহেবের অধীনে নির্বাচনটা মোটামুটি নিরপেক্ষ হয়েছে। এর আগে পরে অনেক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে এবং ওয়ান এলেভেনের আগে বিএনপি কোন ধরনের নির্বাচন করেছিল সেটা দেশবাসী জানে। নিজেদের গদি আকড়ে রাখতে অনেক চেষ্টা করেছে দলটি। অতিরিক্ত ক্ষমতায় থাকার পর জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ নিজের মসনদ টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মানুষের বুকে গুলি চালিয়েও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় কিন্তু যুগযুগ ধরে নয়; এটাই তার জলন্ত প্রমাণ।
বিজ্ঞাপন
লিভিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম কেউ টিকেনি শেষতক। যত ভালো কাজই করুক একসময় আওয়ামী লীগকেও হয়তো সরে যেতে হবে এটাই বাস্তবতা। এই সরকারও একসময় ক্ষমতাচ্যুত হবে, অন্য কোন সরকার দেশ চালাবে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। তবে শেখ হাসিনার সরকারের সময় কিছু দৃশ্যমান উন্নয়নের কথা না বললে এ লেখার নিরপেক্ষতা হারাবে হয়তো। দীর্ঘ ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। এই কয়েকটা বছরে বাংলাদেশের মানুষ যেটা প্রত্যাশা করেনি এমন কিছু উন্নয়ন হয়েছে দেশে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ালে পদ্মা সেতু আমাদের কাছে স্বপ্ন হয়েই দেখা দেয়। কিন্তু এই প্রধানমন্ত্রীর সাহসিকতায় বাস্তবে রূপ নিয়েছে স্বপ্নের সেই পদ্মা সেতু। সেতুর ওপারের জেলাগুলোর মানুষ আজ এ সেতুর কল্যাণে চরম সুফল ভোগ করছেন। বাণিজ্যিক গতিও বাড়িয়ে দিয়েছে এই সেতু। খুলনা, যশোর, বরিশাল, ফরিদপুর কিংবা অন্য কোন জেলাগুলোতে যেতে শুধুমাত্র ফেরির জন্য ৮/১০ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে মানুষকে। এখন সেখানে রাজধানী ঢাকা থেকে দুই থেকে তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। যশোর কিংবা আশেপাশের জেলা থেকে অনেকেই সকালে রওনা দিয়ে মন্ত্রণালয় কিংবা অফিসের কাজ সেরে আবার ফিরে যাচ্ছেন নিজ জেলায় এই সেতুর কল্যাণেই। এ সরকারের সময় দেশে কাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে প্রচুর। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, অফিস-আদালতের ভৌতিক উন্নয়ন লক্ষ্য করছি আমরা। ভাবা কি যায়, আকাশে আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট, যানজটের শহরে মেট্রোরেল তাও আবার জাপানীজ মানের। উত্তরা থেকে যেখানে মতিঝিল দিলকুশা আসতে যেতে দিন পার হয়ে যায় সেখানে কয়েক মিনিটেই মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। এটার সুফল শুরু হয়েছেও। আধুনিক রানওয়েতে সমুদ্রের পানি ছুঁয়ে বিমান উঠানামা করবে এই বাংলাদেশে। এটা বোধ করি বিশ্বে একটাই। আর কক্সবাজারে এমন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করা হয়েছে যেটা সহসাই উদ্বোধন হবে। কক্সবাজারে যাবে রেল, তা আধুনিক। ঢাকায়, ঢাকার বাহিরে রাস্তায় অসংখ্য দ্বিতল, ত্রিতল ফ্লাইওভার, অনেকটা সিঙ্গাপুরের আদলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুবাইয়ের আদলে পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়ক, মাওয়া সড়ক, প্রমত্তা সাগর মোহনায় টানেল, পানির নিচে দিয়ে যাবে গাড়ি। দূরত্ব কমিয়ে দেবে অনেকটা এমন আরও কত কী! এসব এ সরকারের সফলতা বলতে হবে।
বিশ্ব মন্দার কারণে সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক একটা সংকট চলছে। বাংলাদেশে তা দৃশ্যমান বটে। তবে বাংলাদেশের সংকটা একটু বেশি। রির্জার্ভ কমে যাওয়াটা মোটেও ভালো কোন লক্ষণ নয়। এ ব্যাপারে বহু ভুল ত্রুটিও রয়েছে এমন আলোচনা সমালোচনা আছে বহু। দেশ থেকে অর্থ প্রচারের অভিযোগ বহুদিন ধরে চলছে। একটা গোষ্ঠীর হাতে অর্থ চলে যাচ্ছে এমন অভিযোগ আছে। মানুষের নিত্যপণ্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মানুষের আয় কমেছে, ব্যয় অনেক বেড়েছে এসব কথা অসত্য বলার জো নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে রাজনীতিবিদদের হাতে অর্থ কড়ি চলে যায় এটা পুরানো রেওয়াজ। পাড়া মহল্লার ছিঁচকে নেতারাও গাড়ি হাকে, লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে বৈধ এবং অবৈধ পথে। কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষ নেতাকর্মীদের হাতে জিম্মি আছে চরম ভাবে। এমন তথ্য বোধ করি দেশের প্রধানমন্ত্রী কাছেও আছে। আগামী নির্বাচনে অনেক এমপি নমিনেশন নাও পেতে পারেন। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন চ্যানেলে। যারা জনবিচ্ছিন্ন এবং লুটপাট কমিশনখোড়, জুলুমবাজ তাদের ব্যাপারে দলের উচ্চমহলের রিপোর্ট রয়েছে। তারা হয়তো আগত সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পাবেন না এমনটাই বলা হয়েছে সে খবর। এ খবর যদি বাস্তবে রূপ পায় তাহলে সুখবরই বলব দেশের জন্য।
বিজ্ঞাপন
অনেক নেতা, এমপি, মন্ত্রী আছেন যাদের কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মানুষ তাদের মোটেও সহ্য করতে পারছে না। যারা সরকার দল করেন তারাও তাদের কারনে সরকারের সমালোচনা করছে এখন। তারা হয়তো আগামী নির্বাচনে নিজের দলেরই বিরোধ করতে পারে। সন্ত্রাসী লালন করা, মাদক নিয়ন্ত্রণ, খুনখারাবিই তাদের মুখ্য কাজ। সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে তারা ক্ষমতায় থাকে, অবৈধ অর্থ উপার্জন করে। এসব নেতাদের নমিনেশন না দেওয়াই খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এসব সংসদীয় এলাকাগুলোকে যদি এজাতীয় অসৎ নেতাদের নমিনেশন না দিয়ে সৎ এবং ত্যাগীদের নমিনেশন দেওয়া হয় তাহলে সরকারের ভোট বাক্সে ভোট কিছুটা বেশি পড়বে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
এটা সত্য দীর্ঘদিন ক্ষতির ক্ষমতায় থাকার পর জনগণ কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন চায়। বিশেষ করে পরিবর্তন চায় নেতাকর্মীদের হাতে নিভৃতে হওয়ার কারণে, অসহায় বোধ করার কারণে। জনগণকে অসহায়ত্বের জায়গা থেকে তাদেরকে যদি সরিয়ে আনা যায় জনগণ দেশে ব্যাপক উন্নয়নের কারনে হয়তো এই সরকারকে আবারও ভোট দিতে পারে। এজন্য নমিনেশনটা নিরপেক্ষ এবং সঠিক লোককে দেওয়া জরুরি হয়ে পরেছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে কী হবে? আবার সংঘাত, সংঘর্ষ। আমরা দেখেছি, ৫ বছরের শেষ বছরটা ভালোয় ভালোয় কাটে না। মারামারি, খুনোখুনি আর নানা হাঙ্গামায় উত্তপ্ত থাকে দেশ। নির্বাচন সামনে রেখে ভয় সব সময়ই থাকে। বিগত নির্বাচনগুলো একতরফা হলেও এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনে হচ্ছে তা হবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলে কোনো সংশয় নেই। না হলেই যত বিপদ। রাজনৈতিক যুদ্ধ আবারও হতে পারে। তবে এটাই বলতে চাই, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এ সরকারে সময়টা খুব একটা খারাপ যায়নি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ শুরু হয়েছে; দেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকলেও হরতাল অবরোধ না থাকায় জনমনে স্বস্তি ছিল। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পেরেছে, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন হয়েছে। এখন ভয় মূলত এখানেই- এ ধারা ঠিক থাকবে তো? সামনের দিনগুলো ভালো যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আবার জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর, হরতাল-অবরোধ- এসব হবে না তো? সাধারণ মানুষের মধ্যেও নির্বাচন ঘিরে বেশ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। তবে তারা দেশে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো অশান্ত পরিবেশ দেখতে চায় না।
নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে আবারও আন্দোলনের ইস্যু তৈরি হবে, বাড়বে অশান্তি। অর্থনীতি ধ্বংস হবে। সম্পদ নষ্ট হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের জীবন ক্ষয় হবে। দেশে বেকারত্ব বাড়বে, অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দেবে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হবে। এমনটা আমরা কেউই আর চাই না। তবে এটাও সত্য, বিরোধী দলের রাজনীতি করার পরিবেশ দিতে হবে সরকারকে। দেশের স্বার্থে তাদেরও ছাড় দিতে হবে। ক’বছর আগে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে আমরা প্রতিদিন যা দেখেছি, সে কথা এখনও ভুলে যাইনি। চোখের সামনেই ওইসব ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি। কিছুই করতে পারিনি। এসব রোধে আইন যে নেই তাও নয়, আছে। নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজ। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৬-৪৭ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকের অধিকারগুলো বর্ণিত আছে। সেখানে কাউকেই নির্বিচারে মানুষ হত্যার বৈধতা দেয়া হয়নি। এ হত্যার দায় যেমন বিরোধী দলের ছিল, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে সরকারও এ দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না। যখন হরতাল-অবরোধের নামে জীবন্ত মানুষ পুড়ে ঝলসে যায়, যখন তাদের উপার্জনের একমাত্র সম্বল কেড়ে নেয়া হয়; অসহায় স্বজনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়, যখন কষ্টার্জিত লাখ লাখ টাকার সম্পদ চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়- তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনও প্রশ্নের মুখে পড়ে।
আসন্ন নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ- এমন বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে দেশের জনগণ। নির্বাচন নিয়ে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলেও অতীতে বাংলাদেশের কয়টি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নজির রয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। তাই নির্বাচন নিয়ে ভয়; কী জানি কী হয়। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রকৃতই ভয় কাজ করছে সবার মাঝে। নির্বাচনের আগে কেমন যেন দেশের পরিবেশটা ভারী হয়ে আছে। সে ভয় উতরে অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন হোক, এটা সবার প্রত্যাশা।
আমরা চাই না, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো সংঘাত হোক। নির্বাচনী রক্তপাত বহু দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলোকে আগুন নিয়ে খেলা করতে দেখেছি। মানুষের পোড়া লাশ দেখেছি। জ্বালাও-পোড়াও কোনোটা দেখিনি? আমরা চাই না, এ নির্বাচনে কোনোরকম রক্তপাত হোক অথবা প্রাণহানি ঘটুক। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাতময় কোনো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, রক্তপাত যাতে না ঘটে; সেদিকে নজর রাখার আহ্বান জানাই সিইসির কাছে।
এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ নির্বাচন কেমন হবে? নির্বাচন কি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু পরিবেশে হবে? নাকি জোরজুলুমের নির্বাচন হবে- তা নিয়ে দেশজুড়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। এ নির্বাচনে ইসি এবং সরকার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রমাণ করুক, এটাই দেশবাসী চায়। এদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের শঙ্কা থেকেই যায় বারবার। তাই এ নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ করে সামনের জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী এবং ভোটারদের মনে আস্থা তৈরি করুক ইসি।
দেশের সবাই চায় একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। কেউ চায় না ভোটকেন্দ্রে কোনো সংঘাত হোক, কোনো রক্তপাত হোক এবং কোনোরকমের প্রাণহানি ঘটুক। এছাড়া প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনও কেউ কামনা করে না। ভোটের অধিকার প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নাগরিকের। সবাই যেন আনন্দচিত্তে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সে নিশ্চয়তা নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনকারীদের দিতে হবে। তাছাড়া নির্বাচনের পর দেশে যেন কোনোরকম বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। আপামর জনগণের প্রত্যাশাও তাই। নির্বাচনের আগে ও পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা ভালো ভূমিকা থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আচরণবিধি প্রয়োগ করতে গিয়ে এমন কিছু করবে না, যেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। কখনও আইন-কানুনের বিধান থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। নির্বাচন ঘিরে আগে ও পরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, দলসহ সংশ্লিষ্ট সবাই কী করতে পারবে, আর কী পারবে না- তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে আচরণ বিধিমালায়। নিয়ম ভাঙ্গলে শাস্তির বিধানও রয়েছে সেখানে। ভোটের মাঠে সমআচরণ ও সমান সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে। জুডিশিয়াল মাইন্ড ও আইন-কানুন ব্যবহার করতে হবে। আইনকে সমুন্নত রেখে কাজ করলে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন ঠিকই উপহার দিতে পারবে ইসি।
মনে রাখতে হবে, কোনো নির্বাচনে কেবল প্রার্থীর বিজয়েই গণতন্ত্রের বিজয় হয় না; ভোটের সার্থকতা আসে না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কেউ জিতবেন, কেউ হারবেন। যারাই জিতুক, শান্তিপূর্ণ ও অবিতর্কিত নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হলে দলের জয় গণতন্ত্রের জয় বলে প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমরা প্রত্যাশা করি, কোনো রাজনৈতিক চাপে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা যেন বিতর্কিত না হয়। তাই সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিতে পারা এবং স্বচ্ছভাবে ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে। জয়-পরাজয় যারই হোক, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনোভাবেই নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে পরাজিত হলে চলবে না।
আমরা চাই, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হোক। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। জনপ্রত্যাশা হচ্ছে, ইসি সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নির্বাচন। একাদশ জাতীয় নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়- এ প্রত্যাশা সবার। জনগণ চায় ঝামেলামুক্ত রক্তপাতবিহীন নির্বাচন। তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনও প্রত্যাশা করে। বিরোধী দলের জ্বালাময়ী বক্তব্য যেমন জনগণ আশা করে না; তেমনি তারা সরকারি দলের কাছে সমতা বজায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করে। এ অবস্থায় কী করবে নির্বাচন কমিশন? আমরা জানি, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপরই ন্যস্ত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সব নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করার জন্য ওয়াদা করেছেন। তিনি তার ওয়াদা রক্ষা করবেন, এটাই আমরা কায়মনে চাই।
লেখক: মহাসচিব; কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ, চেয়ারপার্সন (পরিবেশ); লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (৩১৫ এ-১)