এনবি নিউজ : রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের গণপরিবহন সেবার অবস্থা যাচ্ছেতাই। নেই শৃঙ্খলা, নেই পর্যাপ্ত যানবাহন, নেই প্রয়োজনীয় রুট। যাত্রী ভাড়া নির্ধারণ করা থাকলেও মানা হয় না তা। আর পণ্যের ক্ষেত্রে তো ভাড়াই নির্ধারণ করা হয়নি। যখন যে সমস্যা বড় আকার ধারণ করছে, তখন সেটির উত্তরণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাও সাময়িক অর্থাৎ অস্থায়ী। ফলে সুফল মিলছে না। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের, তারা হাতের ব্যথায় দাঁতের চিকিৎসার মতো ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না। সব মিলিয়ে দেশে গণপরিবহন সেবার হ-য-ব-র-ল দশা।
রাজধানীর অবস্থা দেখা যাক। গত দুই বছরে ঢাকার রাস্তায় বাস-মিনিবাস নামতে পারছে না। তবে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি কার-জিপ-মাইক্রোবাস। বলা হয়েছে বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজির মাধ্যমে গাড়ি চলবে। কিন্তু মাত্র দুটি রুটে এখন বিআরটিসির বাস চলছে, তাও লোকসান দিয়ে। বেসরকারি বাস মালিকরা গচ্চা দিতে রাজি নন। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা আগেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। ঢাকা শহরের ভেতরে যানবাহনের চাপ কমাতে গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী টার্মিনাল শহরের বাইরে সরিয়ে নেওয়া হবে বলা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু সেটি শুধু বলাতেই রয়ে গেছে, বাস্তবতা পায়নি। রাজধানীতে মেট্রোরেল চালু হলেও সেটি স্রেফ মতিঝিল-উত্তরা রুটে, যা পুরো রাজধানীর যাত্রীচাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তা ছাড়া মেট্রোতে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে ভাড়া অনেক বেশি বলে এর সমালোচনাও রয়েছে।
পদ্মা সেতু চালুর পর গাবতলী, মহাখালীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শহরের ভেতর দিয়ে অবৈধভাবে দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়ছে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে। রুট পারমিট নেই, তবু চলছে গাড়ি। সায়েদাবাদ বা যাত্রাবাড়ী দিয়ে চলাচল করা গাড়িও রুট পারমিট ছাড়াই দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে। সারা দেশে গাড়ি চলাচলের ১২৯৯টি রুট রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীর জন্য ১০৬টি। নতুন করে রুট পারমিট বন্ধ রাখলেও শহর থেকে টার্মিনাল সরানো কিংবা টার্মিনালের অবকাঠামো বর্ধিতকরণ কোনোটাই সম্ভব হয়নি।
এদিকে এমআরটি, বিআরটি কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণকেই একমাত্র সমাধান দেখিয়ে প্রকল্পের পর প্রকল্প বানাতে ব্যস্ত কর্মকর্তারা। শহরের রাস্তা বৃদ্ধিতে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাদের। অথচ আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা ঢাকায়। আছে মাত্র ৯ শতাংশ।
ঢাকা মহানগরীতে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ নানা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু খেয়াল কম গণপরিবহনের দিকে। ব্যক্তিগত গাড়িই নামছে বেশি। প্রতিদিন দেশের সড়কে নতুন করে নামছে ১ হাজার ৪০৯টি মোটরসাইকেল, ৫০টি প্রাইভেট কার আর ১০টি করে বাস। প্রাইভেট কারের আধিক্য ঢাকার রাস্তায় যানজটের অন্যতম কারণ। ইতোমধ্যে বিমানবন্দর থেকে কারওয়ানবাজার এফডিসি পর্যন্ত চালু হওয়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যানজটও সেই বার্তাই দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাইভেট গাড়ি নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে সড়কের সীমাবদ্ধতা ও পরিমাণ বিবেচনা করা উচিত।
জানা গেছে, মেট্রোর পাশাপাশি উন্নত বিশে^ বাস সার্ভিস রয়েছে। যাত্রীরা তাদের সময়সূচি ও গন্তব্য বিবেচনায় পছন্দের বাহন বেছে নেন। কেবল ঢাকাতে ব্যতিক্রম। বেসরকারি বাস-মিনিবাসে চলাচল দুষ্কর নিম্নমানের সেবার কারণে। পরন্তু এসব গাড়ি যানজটে আটকে থাকে দীর্ঘকাল। কিন্তু ব্যাগেজসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে সড়কপথেই চলতে হয়। মেট্রোতে সে সুযোগ নেই। সিএনজি অটোরিকশার মিটারে না চলার অভিযোগ পুরনো। এখন রাইডশেয়ারিং সেবার মানও নিম্নগামী। চালক-যাত্রী সবাই অতিষ্ঠ এ সেবা নিয়ে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ঢাকা শহরে মাত্র ৬শ বাস পরিচালনা করে। সর্বসাকুল্যে সংস্থাটির বাস রয়েছে ১৩৫০টি। অন্যদিকে ঢাকা শহরে সচল রুটে বেসরকারি বাসের রুট পারমিট রয়েছে ৪ হাজার ৪৪৮টির। এর মধ্যে বাস ৪৩৯১টি এবং মিনিবাস ৫৭টি। তবে সিলিং বা অনুমতি রয়েছে ৬৯৫৫টি বাসের।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। সচল রুট বিশ্লেষণ করেছে শিকড় পরিবহনের ১৩০টি বাসের সিলিং রয়েছে। এর মধ্যে চলছে ৩২টি। প্রায় একই রুটে মিরপুর ইউনাইটেড সার্ভিসের ৫৪টি গাড়ির সিলিং আছে। এর মধ্যে চলছে ১৩টি। মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে সদরঘাট তানজিল পরিবহনের ৫০টির সিলিং আছে। বাস চলে ২৯টি। সাভার (ইপিজেড) থেকে লিঙ্ক রোডে ১৪৪টি বাসের মধ্যে চলে ৪০টি। এ রকম প্রায় প্রত্যেকটি রুটে সিলিংয়ের তুলনায় চলাচলরত গাড়ির সংখ্যা কম। এর বড় কারণ রুট অনুযায়ী যাত্রীচাহিদার প্রতিফলন নেই। কাক্সিক্ষত যাত্রীর অভাবে রাস্তায় গাড়ি নামাতে চাইছেন না বাসমালিকরা। তা ছাড়া যানজটের কারণে ট্রিপের সংখ্যা কমে যাওয়ার সমস্যা তো রয়েছেই।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, সড়ক, রেল ও নৌ সব দিকেই যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি সড়ক থেকে কমাতে পারলে বাস-মিনিবাস সার্ভিস গুরুত্ব পাবে। কেবল সড়ক নয়; গণপরিবহন হতে হবে সমন্বিত।
২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা ‘বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজ’ চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়া। সহজ শর্তের ঋণে নতুন বাস নামানো। বাস চলবে পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির অধীন। মালিকরা বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পাবেন। বেসরকারি বাসমালিকরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের বাস কিনে নিতে। তা আর হয়ে ওঠেনি। ফলে উদ্যোগটি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। যে একটি বেসরকারি কোম্পানি বাস নামিয়েছিল, তারাও লোকসানের ভারে সরে যায়। এবার আসা যাক রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিয়ে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো বিশেষ করে উবার শুরু থেকেই কয়েক ধরনের প্রমো ও মাসে ৮০ হাজার টাকা আয়ের নিশ্চয়তামূলক বিভিন্ন চমকপ্রদ প্রচার শুরু করে। ফলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চালকরা এটিকে পেশা হিসেবে নিতে শুরু করে। কিন্তু এখন যাত্রী-চালক সবাই হতাশ। সেবা ও যাত্রী নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। লাভ কেবল অ্যাপস কোম্পানির। যাত্রী পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়া মানছে না পরিবহন কোম্পানি। আবার পণ্য পরিবহনে ভাড়ার হার নির্ধারণ হয়নি আজও। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরি সভাপতি সৈয়দ মো. বখতিয়ার বলেছেন, পণ্য পরিবহনে ভাড়ার নির্ধারণ নেই। এটি করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাড়ার অভিযোগ আসে। কিছু ক্ষেত্রে মালিকরাও মনে করেন তাদের গচ্চা যায়। তাই ভাড়া নির্ধারণ দরকার।
ঢাকা মহানগরীতেই শুধু নয়, সারা দেশেই পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খল অবস্থা। রুট পারমিটের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিআরটিএ সদর কার্যালয়ের অধীনে দূরপাল্লার রুটে ৩৯১টি রুটের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকার ১০৬, চট্টগ্রাম মহানগরের ১৭, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ৩৪, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় ৩০, রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয় ৮, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় ৯, বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় ৯, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় ৫ এবং সকল জেলা থেকে ৬৯০টি রুট রয়েছে।
যানবাহনের রুট পারমিট প্রদানে নিয়ম হচ্ছে প্রথমে অস্থায়ী পারমিট দেওয়া। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় চলাচলকারী বাসের ক্ষেত্রে বড় অবলম্বন হানিফ ফ্লাইওভার। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ রুটে গাড়ি চলাচলের আবেদন বাড়তে থাকে। বেড়ে যায় বাসের সংখ্যা। নতুন করে চালু হওয়া অনেক বাসের অনুমোদন নেই। কিছু বাসের অনুমোদন দিলেও এখন আর চলতে পারবে না। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে দক্ষিণাঞ্চলগামী ১২টি রুটে আনুমানিক ১ হাজার বাস চলাচল করে। এ ছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে আসা ৩টি রুটের গাড়ি ফ্লাইওভার দিয়ে পদ্মা সেতু পার হতে পারছে। এসব বাস আগে যেত ফেরি দিয়ে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পদ্মা সেতুমুখী বাস হানিফ ফ্লাইওভারে উঠতে পারবে না। এ সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। রুট পারমিট নেই, কিন্তু গাড়ি চলছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ২ কোটি ৮১ লাখ ২৬০টি। একই রুটে একাধিক পরিবহনের বাস চলাচল করায় যাত্রী টানতে দেখা যায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বেসরকারি বাসের আসন-জানালার কাচ ভাঙা নিয়ে কথা বলার আগেই শুরু হয় ভাড়া নিয়ে বাগবিত-া। যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহনকর্মীদের অসদাচরণ নিত্যঘটনা। বিআরটিসি বহরে সারাদেশে বাসের সংখ্যা মাত্র ১৩৫০টি। এর মধ্যে ২৬৫টি বাসের মেয়াদ আগামী বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। নতুন বাস বহরে ঠিক কবে যোগ হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। অথচ বেসরকারি মালিকদের ওপর নির্ভরতা কমাতে বিআরটিসির বহরে বাস বাড়ানো জরুরি। তার চেয়ে বড় কথা, করপোরেশন এখন লাভের মুখও দেখছে। বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, বিআরটিসির বাস চলাচল করে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাস অ্যাসেম্বলি করার চিন্তা চলছে। বিআরটিসিতে নতুন বাস ও ট্রাক কেনার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, গণপরিবহনের শৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত অনেকগুলো সংস্থা। রুট পারিমট দেয় আরটিসি আবার রেজিস্ট্রেশন-ফিটনেস দেয় বিআরটিএ। নগর পরিবহনের আওতায় দুটি রুটে চলছে নগর পরিবহন। আবার সিটি করপোরেশনের অধীনে রয়েছে টার্মিনাল। ডিটিসিএ এ নিয়ে কাজও করছে। সব সংস্থার সমন্বয়ে পরিবহন খাতের উন্নতি সম্ভব এবং তা-ই করা হচ্ছে।