আওয়ামী লীগে গৃহবিবাদ : দেখার নেই কেউ
|
১৪ চৈত্র ১৪৩০ |
Thursday, March 28, 2024
স্বতন্ত্র কৌশল নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করা গেলেও এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আওয়ামী লীগের ওপর। বিবাদ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন দলের মাঠের নেতা-কর্মীরা। অভিযোগ, কলকাঠি নাড়ছেন বর্তমান এমপিরা। যারা কেউ নৌকা কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অন্য প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচনে জিতেছেন। এ গৃহবিবাদ দেখার নেই কেউ। অথচ এসব দেখার জন্য সাংগঠনিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছেন একাধিক নেতা। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে নেতাদের উসকে দেওয়ার। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন আত্মঘাতী রূপ নিচ্ছে। এতে সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করছে। গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন উন্মুক্ত থাকার কারণেই আজকে সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। সর্বশেষ নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বরিশালের হিজলায় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে। এ নির্বাচনি এলাকায় পরিস্থিতি থমথমে। জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন, তারা এখন ‘এমপি’ লীগ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আবার যারা নৌকা নিয়ে টেনেটুনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছেন তারা এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের নির্মূলে নেমেছেন। ফলে আওয়ামী লীগই এখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে শুধু বিব্রতই করছে না, দলকে চিরস্থায়ী বিভক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী দলের অভ্যন্তরীণ জটিলতা নিরসনে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবিক কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। ফলে কোথাও কোথাও হামলা-মামলা, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়েছে। দল ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নাজুক। অনেক জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন সম্মেলন নেই। আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামের হৃৎপিণ্ডখ্যাত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যত এখন অচল। থানা-ওয়ার্ডে কোনো কমিটি নেই। কারা দায়িত্ব পালন করবে সঠিক নির্দেশনাও নেই। প্রবীণরা বলছেন, দ্রুততম সময়ে সাংগঠনিকভাবে দলকে ঢেলে সাজানো না হলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে মাশুল দিতে হবে।
অনেকেই মনে করেছিলেন যে, নির্বাচনের পর এই সহিংসতা বন্ধ হবে। কিন্তু নির্বাচনি সহিংসতা এমন এক ধরনের সংঘাত, যেটি যুগ যুগ ধরে চলে। এখন আওয়ামী লীগকে সেই ভার বহন করতে হচ্ছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে একাধিকবার বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে যে, যেন স্থানীয় বিরোধগুলো মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেই বিরোধের মীমাংসার জন্য কেউই আসলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঈদের পর দলের সাংগঠনিক সফর শুরু হবে। জেলা-উপজেলায় সেই নেতাদের সঙ্গে বসে বিরোধ নিরসন করা হবে। আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ সংকট দূর হবে।’
গত শনিবার বরিশালের হিজলায় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন জামাল মাঝি (৫৫) নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা। নিহত জামাল স্থানীয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের অনুসারী। আর জামাল মাঝির প্রতিপক্ষ ধুলখোলা ইউপি চেয়ারম্যান জামাল ঢালী সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ড. শাম্মী আহমেদের অনুসারী। জামাল মাঝি ধুলখোলা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন। এমপি পঙ্কজ দেবনাথের অনুসারী হওয়ায় তার ওপর আগেও একাধিকবার হামলা হয়েছে। জামাল মাঝির স্ত্রী আঁখি নূরের অভিযোগ, ধুলখোলা ইউপি চেয়ারম্যান জামাল ঢালী, মনির সিকদার, বাসেদ চৌকিদাররা কুপিয়ে হত্যা করেছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের অভিযোগ, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য শাম্মীর লোকজন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর দায় এড়াতে পারেন না তিনি। জানা গেছে, পঙ্কজ দেবনাথ ও শাম্মী আহমেদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। যে কারণে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জে একাধিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হামলা-মামলায় অনেকেই এখন বাড়িছাড়া।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহীর তানোরে জিয়ারুল হক (৩৬) নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত জিয়ারুল হক তালন্দ ইউনিয়নের বিলশহর গ্রামের মোহর আলীর ছেলে। জিয়ারুল রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানীর চাচাতো ভাই। গোলাম রাব্বানী অভিযোগে বলেছেন, গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে জিয়ারুল তার পক্ষে ব্যাপকভাবে কাজ করেন। ওই নির্বাচনে জিয়ারুলের ব্যাপক ভূমিকার কারণে লালপুর স্কুল ভোট কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাঁচি প্রতীক, নৌকা প্রতীকের চেয়ে ৬ শতাধিক ভোট বেশি পেয়েছিল। ভোটের পর থেকে প্রতিপক্ষের ব্যাপক হুমকিতে ছিলেন তিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা জিয়ারুলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী।
বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলাই ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এমন প্রেক্ষাপটে দলটির মধ্যে যারা ভোটে দাঁড়াতে আগ্রহী, তাদের সবাইকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দল থেকেও প্রতি আসনে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর ফলে তৃণমূলে কোন্দল বাড়তে থাকে, যা অনেক জায়গাতেই সহিংসতায় রূপ নেয়।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল, ভোটের মাঠ উন্মুক্ত করে দেওয়া। দলের এ সিদ্ধান্তের কারণে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল-সর্বস্তরের নেতারা এবার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান। এবারের নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে ৩০০-এর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, যার মধ্যে ২৬৯ জনই ক্ষমতাসীন দলের। প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি আরও নাজুক হয় নির্বাচনের পর। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন, যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক শীর্ষ নেতা ও হেভিওয়েট নৌকার প্রার্থীও এবার হেরেছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন কিন্তু জিততে পারেনি এমন পরিচিত নেতাদের মধ্যে আছেন বিগত সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। এ ছাড়াও হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফরউল্যাহ, প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান মিয়া, সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস প্রমুখ। নির্বাচনের পর গত আড়াই মাসে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও দোকান, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে।
নির্বাচনের পর সহিংসতার খবর বেশি পাওয়া গেছে মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, রাজশাহী, পিরোজপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, খুলনা, পটুয়াখালীসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলায়। এসব সংঘাত-সহিংসতার বেশির ভাগই ঘটেছে নৌকা প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে, যারা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় সদস্য।
মুন্সীগঞ্জে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে হেরেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ও প্রভাবশালী নেতা মৃণাল কান্তি দাস। নির্বাচনের দিন সহিংসতায় সেখানে একজন মারাও গেছেন। সেখানে এখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পক্ষের বিরোধ স্পষ্ট। একইভাবে বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে ফরিদপুরে। ফরিদপুর-৩ আসনের নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ছেন ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ।
নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক। নির্বাচনের পর দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আজাদের সমর্থকরা আমন্ত্রণ পাচ্ছেন না। ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় সম্প্রতি তাকে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে আজাদের সমর্থকদের ডাকা হয়নি। একইভাবে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কিংবা তাদের অনুসারী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না। মানিকগঞ্জ-২ আসনে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন তিনবারের সংসদ সদস্য কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিতেছেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু। নির্বাচনে হারার পর মমতাজও ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন। ফলে বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্বও এখন চরমে পৌঁছেছে। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। সদর আসনের এমপি জাহিদ ফারুক বনাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থকরা দুই ভাগে বিভক্ত। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে যশোরে একটি উপজেলার নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যানকে এলাকাছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে।
সোহেল সানি ও রফিকুল ইসলাম রনি (বাংলাদেশ প্রতিদিন)