মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো
|
১৪ চৈত্র ১৪৩০ |
Thursday, March 28, 2024
জিট : ২৮৩)
মো: সাহাবুদ্দিন : স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের যে ঐক্য, সাহস এবং ধৈর্য দেখেছি তা যেন এখন ইতিহাস হয়েই থাকছে। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। লাখো শহিদের আত্মত্যাগ এবং কোটি মানুষের সম্পদ এবং মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা বিশ্বে বাঙালিদের মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন দেখেছি। তখন আমি কলেজের ছাত্র, জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। গণআন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি ফুঁসে উঠল। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ হয়ে আন্দোলনের ঢেউ লাগে স্কুল পর্যায়ে। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আমরা মিছিলে যেতাম বড় ভাইদের আহ্বানে।
পাকিস্তান জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের প্রচারে আমরা ছাত্ররা অংশ নিই। বক্তৃতা ভালোই দিতে পারতাম। এ কারণে অগ্রজ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন স্থানে আমাদের নিয়ে যেতেন জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। জনসভার শুরুতে বক্তৃতা দিয়ে আমি আসর গরম করতাম। সমগ্র জেলা চষে বেড়াতাম আহমেদ রফিক, আমি, আবদুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু, পাকনসহ কয়েকজন। ছাত্র-যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে দিন-রাত কাজ করতাম। নাওয়া-খাওয়া অনেক দিন হতোই না। চিড়া-গুড়-মুড়িতেই সারা দিন চলে যেত। এখনকার মতো তখন যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। কখনো পায়ে হেঁটে, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বা নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল গভীর সখ্য এবং আন্তরিকতা। অগ্রজদের সম্মান করত অনুজরা। আমরা বড়দের আদেশ-নির্দেশ বিনাবাক্যে মাথা পেতে কাজ করতাম।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সব প্রার্থী জয়লাভ করলেন। বৃহত্তর পাবনা জেলার (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) সব জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের ২৮৮টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। আমরা ছাত্র-জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ বসবে। কিন্তু ক্রমশই আমাদের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। বুঝলাম, পাকিস্তানিরা সহজে বাঙালির হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে লাগল পাকিস্তানের নেতারা। তারা ঢাকা-চট্টগ্রামে সৈন্য সমাবেশ করাসহ সারা দেশে সৈন্য প্রেরণ করে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে লাগল। অবস্থা দেখে মনে হলো পাকিস্তানিরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অধীর আগ্রহ এবং শঙ্কায় অপেক্ষা করতে হলো সবাইকে।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিলেন। তখন আমি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। আহ্বান জানালেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার। ওই দিন আমরা কয়েক বন্ধু বসে ছিলাম রেডিওতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য। কিন্তু ভাষণের পরিবর্তে রেডিওতে গান বাজানো হচ্ছিল। পরে জানা গেল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হবে না। পরদিন সকালে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষণ রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বান মোতাবেক আমরা প্রস্তুত হতে শুরু করি। প্রতিদিন শহরে মিছিল হতো, আমরা কজন থাকতাম মিছিলের অগ্রভাগে। আমাদের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো’, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার-আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ ইত্যাদি। পুরোনো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে ছাত্র-যুবক, কৃষক-জনতা ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে জড়ো হলো। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আমজাদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম বাদশা, প্রসাদ রায়, মহবুবুল হক ওরফে ফেরু দেওয়ান, রণেশ মৈত্র, আবদুর রব বগা মিয়ার তত্ত্বাবধানে পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা কসিম উদ্দিন শারীরিক এবং মানসিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন। আমি যেহেতু রাইফেলস ক্লাবের সদস্য ছিলাম, আমরা রাইফেলস ক্লাবের কয়েক সদস্য মাওলানা কসিম উদ্দিনের সহকারীর দায়িত্ব পালন করতাম। জাতীয় পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন নাটোর থেকে পাবনা ফেরার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা একজন বিজ্ঞ দেশদরদি নেতাকে হারালাম।
২৫ মার্চের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী পাবনায় অবস্থান নেয়। হানাদার বাহিনী শহরের পুরোনো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এবং বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থান নেয়। আমরাও প্রস্তুতি নেই। জেলা প্রশাসক নূরুল কাদির খানের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। পুলিশের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগার থেকে আমাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হলো। এ সময় নকশালপন্থিরাও অস্ত্রের দাবি করলে তাদের সঙ্গে বিরোধ হয়।
এখানে উল্লেখ্য, নকশালপন্থিদের সঙ্গে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই পাবনায় দ্বন্দ্ব ছিল আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের। মার্চের শেষ সপ্তাহের দিকে পাবনায় অবস্থান নেওয়া প্রায় পঞ্চাশজন পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের হাতে নিহত হয়। দিনভর যুদ্ধ হয় পুরোনো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন। হাজার হাজার জনতা দেশীয় অস্ত্রসহ পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘিরে রাখে এবং মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-পাতাল প্রকম্পিত করে রাখে। হানাদার সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যায়। এভাবে ১০ দিন পাবনা শত্রুমুক্ত থাকে। এরপর শহরে বিমান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমরা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিই। ছাত্র-জনতা বেশ কয়েকজন ইপিআর সদস্য এবং পুলিশের সঙ্গে নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান নেয়। ৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী জল, স্থল এবং আকাশপথে আমাদের অবস্থান বা বাঙ্কারের ওপর গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। আমাদের কাছে ছিল হালকা অস্ত্র। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী মেশিনগানের গুলি, শেল নিক্ষেপ এবং ওপর থেকে বিমানের গুলিবর্ষণে আমরা টিকে থাকতে পারছিলাম না। আমরা আমাদের কমান্ডারের নির্দেশে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিই। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা আরিচাঘাট থেকে গোলাবর্ষণ করতে করতে ফেরি, লঞ্চ এবং নৌকায় যমুনা নদী পার হয়ে পাবনার খাঁপুর হাই স্কুলের মাঠে জড়ো হয়। সেখান থেকে তারা বিমানবাহিনীর ছত্রছায়ায় অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার সময় হানাদাররা সড়ক পথের দুই ধারের বাড়িঘর, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে। নগরবাড়ী থেকে কাশিনাথপুর হয়ে আহম্মদপুর, বনগ্রাম, চিনাখড়া, আতাইকুলা, পুষ্পপাড়া বাজারসহ সড়কের উভয় পাশের বাড়িঘর পুড়িয়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে বিকালবেলায়। হানাদার সৈন্যরা এ সময় গানপাউডার ব্যবহার করে। যেখানে যে অবস্থায় যাকে পেয়েছে গুলি করে হত্যা করে। দৃষ্টির মধ্যে পড়া কৃষককে গুলি করে হত্যা করে। অনেক কৃষক ক্ষেতে কাজ করা অবস্থায় গুলিতে নিহত হয়। অনেক গবাদিপশু মারা যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে।
আমরা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের দলে ছিলেন ভাষাসৈনিক আমিনুল ইসলাম বাদশা, রবিউল ইসলাম রবি, রফিকুল ইসলাম বকুল, ইকবাল হোসেন, শিরিন বানু মিতিল, আবুল কালাম আজাদ বাবুসহ ১০ জন। নৌকায় পদ্মা এবং গড়াই নদী অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-মিরপুর হয়ে শিকারপুর-প্রাগপুর হয়ে ১১ এপ্রিল কেচুয়াডাঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যোগ দিই। ১৬ এপ্রিল রাতে আমরা জানতে পারি ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (পরে নামকরণ হয় মুজিবনগর) অস্থায়ী সরকার গঠন করা হবে। পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদির খান, রফিকুল ইসলাম বকুল, মোহাম্মদ ইকবাল এবং আমি মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমরা শ্রদ্ধেয় এম মনসুর আলীর সঙ্গে ছিলাম সার্বক্ষণিকভাবে। মুজিবনগরের আম্রকাননে আমাদের সঙ্গে নূরুল কাদির খান সাহেব পরিচয় করিয়ে দেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম এবং ড. আহসাবুল হক এমপির সঙ্গে। শপথগ্রহণ শেষে ভারতীয় এবং বিদেশি সাংবাদিকদের যানবাহনের বহরে একটি জিপে আমরা কজন কলকাতায় ফিরে যাই। সেখান থেকে পরদিন আমরা চলে যাই কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে।
কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন পুলিশের আরআই আবুল খায়ের। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য সহযোগীদের পাঠানো হলো ভারতের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। আমাকে কেচুয়াডাঙ্গা যুব ক্যাম্পে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বন্ধু মুক্তার হোসেনকে দেওয়া হয় রেশন দ্রব্যাদি সংরক্ষণের দায়িত্ব। এ সময়ই আমরা কজন ছাত্রনেতা ভারতের নেতৃবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতার জন্য বিশেষ করে অস্ত্রের জন্য কলকাতায় যাই। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে একদল ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে সাংবাদিকদের সামনে নিয়ে গেলেন। আমি আমার সহযাত্রীদের পক্ষে সাংবাদিকদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা দিলাম। তখন ভারতে লাখ লাখ শরণার্থী প্রবেশ করছে। বানের পানির মতো শরণার্থীর স্রোত। কলকাতায় সাক্ষাৎ হয় এম মনসুর আলীর পুত্র আমাদের অগ্রজ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে। কয়েক দিন কলকাতায় থাকার পর মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে বিভিন্ন যুব ক্যাম্পের পরিস্থিতি দেখার জন্য রওনা হই। বিভিন্ন যুব ক্যাম্পে আমরা যুবকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য কথা বলতাম। দেশের অভ্যন্তরের খবর অনেক যুবকই জানতেন না। তারা ভারতে গমন করেছেন মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। কিন্তু তাদের মন ছিল ভারাক্রান্ত। কারণ তারা তাদের বাড়িঘর এবং স্বজনদের রেখে গেছেন। স্বজনরা কে কেমন আছেন এই ছিল তাদের চিন্তা। বাড়িঘর পাকিস্তানি হানাদাররা পুড়িয়ে দিয়েছে, অনেকের মা-বাবা, ভাই-বোনকে হত্যা করেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত যুবকরা ছিলেন শোকাহত। কিন্তু তাদের ছিল দুরন্ত সাহস। মোহাম্মদ নাসিম এবং আমি তাদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিতাম। যুবকদের তখন বেশ উজ্জীবিত হতে দেখেছি। দেশমাতৃকার জন্য তাদের কষ্ট এবং ত্যাগের কথা কখনো ভুলব না। প্রশিক্ষণরত যোদ্ধারা অস্বস্তিতে থাকলেও যুদ্ধের সময় চরম সাহসিকতা, ধৈর্য ও মনোবল স্বাধীনতাকামীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
মধ্য অক্টোবরে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধকালীন সময়ের যুব কমান্ড নেতা তোফায়েল আহমেদের কাছ থেকে অস্ত্র গ্রহণ করার পর সেখানে আমাদের বিদায় দেন বেবী ইসলাম (কদিন পরে তিনিও আমাদের দলে যোগ দেন)। মোহাম্মদ ইকবালের নেতৃত্বে প্রাগপুর সীমান্ত অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে পাবনা শহরের পশ্চিম দিকের পদ্মার আফতাবনগর চর এবং চর গড়গড়িতে অবস্থান নিই। সেখানে আমরা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিই। কিন্তু প্রথমেই আমরা বাধার সম্মুখীন হই। সেই পুরোনো শত্রু তখনও আমাদের পিছু ছাড়েনি। চর সানিরদিয়ারে অবস্থানরত নকশালরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আমাদের ক্যাম্পের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরাও পাল্টা গুলি করতে থাকি। নকশালদের সঙ্গে যোগ দেয় পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী। সারা রাত যুদ্ধ চলে। আমাদের অকুতোভয় গেরিলা যোদ্ধারা সামান্য গোলাবারুদ দিয়েই তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা নকশালদের সঙ্গে যোগ দেয় ভারী অস্ত্র নিয়ে। তখন আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। আমরা নিরাপদ স্থানে ঈশ্বরদীর দাদাপুর চরে চলে যাই। এই যুদ্ধে শহিদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ। যুদ্ধে নকশালদের দুজন নিহত হয়। তার মধ্যে একজন ছিলেন টিপু বিশ্বাসের ভাই। ওই যুদ্ধে রফিকুল ইসলাম বকুল, মোহাম্মদ ইকবাল ছাড়াও অংশ নেন ফজলুল হক মন্টু, বেবী ইসলাম, ইসমত হোসেন, আবুল কালাম আজাদ বাবু, মকবুল হোসেন সন্টু, হাবিবুর রহমান হাবিব, শাহাদত হোসেন সন্টু, জহুরুল ইসলাম বিশু, অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, সেলিম, মোহন, সোটকা, রুকু, জিন্নাহ, রাজ্জাক, পাকন, শরীফ, শহিদুল্লাহ প্রমুখ সাহসী যোদ্ধা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের পাবনাবাসীকে তথা মুক্তিযোদ্ধাদের একাধারে তিন শত্রুকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রথমত চীনপন্থি বা মাওবাদী নকশালদের, তারপর হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের এবং মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীদের।
গেরিলা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করি। রফিকুল ইসলাম বকুল এবং জহুরুল ইসলাম বিশু একটি গ্রুপ নিয়ে সুজানগর এলাকায় অবস্থান নেয়। এরপর আমি চলে যাই কলকাতাস্থ ৮নং থিয়েটার রোডের বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে। থিয়েটার রোডের কার্যালয়ে আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতাম। কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল অতিথিদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করা। বিশেষ করে বিদেশি সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি তুলে ধরা এবং তাদের সঙ্গে শরণার্থীদের কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া। এর বাইরেও আমরা কজন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতাম। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কলকাতা শহরে ব্লাক আউট। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী এবং বিবিসি রেডিওতে আমরা পাকিস্তানিদের পরাজয়ের খবর শুনে ক্যাম্পে বসে উল্লাস করি। ঢাকার দিকে মিত্র সেনাদের অগ্রযাত্রা। যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন। আমি কলকাতা থেকে ১৪ ডিসেম্বর কেচুয়াডাঙ্গা যাই। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। ১৭ ডিসেম্বর আমরা প্রস্তুতি নিলাম এবং ১৮ ডিসেম্বর কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্প গুটিয়ে একটি ট্রাক ভরে তাঁবু, তৈজসপত্র, কম্বল, মশারির স্ট্যান্ডসহ যাবতীয় দ্রব্যাদি নিয়ে পাবনা ফিরলাম। ওইসব দ্রব্য পাবনা জেলা স্কুলের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রফিকুল ইসলাম বকুল এবং মোহাম্মদ ইকবালের কাছে হস্তান্তর করি। পরে সেগুলো পাবনা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের (বর্তমান ক্যাডেট কলেজ) ভারতীয় সেনাদের ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়।
মো. সাহাবুদ্দিন
রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
(অনুলিখন : হাবিবুর রহমান স্বপন)