মার্কিন মদদেই কি যুদ্ধবিরতি আটকে রাখছে ইসরাইল
|
১৪ চৈত্র ১৪৩০ |
Thursday, March 28, 2024
নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হওয়ার দুদিন পরে এসেও পৃথিবীর সবথেকে বড় খোলা গোরস্তানে রূপান্তরিত গাজা উপত্যকায় হামলা থামায়নি ইসরাইল। বুধবার দেওয়া গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, আগের ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৭৬ জন ইসরাইলি হত্যার শিকার হয়েছেন। পাস হওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে উল্টো জাতিসংঘকেই একহাত নিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার অভিযোগ গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে যে আলোচনা চলছিল, নিরাপত্তা পরিষদের পাস হওয়া প্রস্তাব সেই আলোচনা ভেস্তে দিয়েছে।
নেতানিয়াহুর দাবি, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হওয়ায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস নিজেদের অবস্থান কঠোর করছে। জাতিসংঘে ভোটাভুটির পর হামাস যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে নেতানিয়াহুর এমন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বাইডেন প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুধবার টাইমস অব ইসরাইলকে তিনি বলেন, হামাস ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির আগে। নেতানিয়াহু এটা নিয়ে রাজনীতি করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। মার্কিন কর্মকর্তা এমন মন্তব্য করলেও যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানার বাধ্যবাধকতা নেই ইসরাইলের। সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মদদেই নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হচ্ছে কি না।ইসরাইল বলছে, হামাসের দাবি-দাওয়ার কারণে ‘কানা গলিতে আটকে গেছে’ গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনা। যে কারণে ইসরাইল নিজেদের প্রতিনিধিদের দোহা থেকে দেশে ডেকে পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোসাদ প্রধানের ঘনিষ্ঠ ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, গাজার হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ‘রমজানে এই যুদ্ধকে আরও উসকে দেওয়ার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে’ কূটনৈতিক নাশকতা চালাচ্ছেন।
কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় মুসলমানদের পবিত্র মাস রমজানে গাজায় ছয় সপ্তাহের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উপনীত হতে দোহায় আলোচনা শুরু হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, ইসরাইল ছয় সপ্তাহ গাজায় অভিযান বন্ধ রাখবে। বিনিময়ে এখনও হামাসের হাতে বন্দি ১৩০ ইসরাইলি জিম্মির মধ্যে ৪০ জনকে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু হামাস গাজা যুদ্ধের অবসান এবং সেখান থেকে ইসরাইলি সৈন্যদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার দাবি করে বসে আছে। যে দাবি উড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল বলেছে, হামাসকে সম্পূর্ণ রূপে নির্মূল না করা পর্যন্ত তাদের এই অভিযান বন্ধ হবে না।
সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুষ্ঠিত ভোটে গাজা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটি পাস হয়। ওই প্রস্তাবে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং আটক সব জিম্মির মুক্তির দাবি তোলা হয়। এ বিষয়টিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল ইসরাইল। এর আগে এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছিল, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুল্যুশন’ কী পরিমাণ ক্ষতি বয়ে এনেছে তার ‘একটি দুঃখজনক প্রমাণ’ হলো হামাসের মার্কিন মধ্যস্থতাকারীদের সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। বাইডেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নেতানিয়াহুর এমন দাবির প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘এই বিবৃতিটি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভুল এবং জিম্মি ও তাদের পরিবারের প্রতি অন্যায্য’ আচরণের প্রকাশ।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গাজায় এখনও আটক ১৩৪ ইসরাইলি জিম্মির মুক্তির বিষয়টি অবহেলা করার অভিযোগ এনেছেন মার্কিন ওই কর্মকর্তা। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল এই ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করব না। আমরা বরং বাকি জিম্মিদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর কাজে মন দেব।’মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার একই ধরনের মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। মিলার বলেন, ‘হামাসের প্রতিক্রিয়ার যে বর্ণনা জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণই প্রচারিত খবর থেকে এসেছে। সেগুলো হামাসের প্রতিক্রিয়ার অংশ নয় এবং প্রতিক্রিয়াটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভোটের পরে নয়, বরং আগে তৈরি করা হয়েছিল।’
জাতিসংঘ প্রস্তাব মানা বাধ্যতামূলক কিনা : জাতিসংঘ সনদের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা বর্তমান সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সম্মত।’ জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বলা আছে : ‘জাতিসংঘে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলোর মাঝে যেগুলো নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পেয়ে থাকে, সেগুলো মেনে চলার আইনি বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে।’তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৭২৮ নম্বর প্রস্তাবকে বাধ্যতামূলক নয় বলে বর্ণনা করেছে। তাদের যুক্তি, ওই প্রস্তাবে ‘যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ কথাগুলোর পরিবর্তে বরং ‘যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করা হয়েছে’ অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারও সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি একটি বাধ্যতামূলক প্রস্তাব নয়।’
জাতিসংঘের অন্য কর্মকর্তারা বলছেন উল্টো কথা। জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মানা বাধ্যতামূলক। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মার্ক লায়াল-গ্রান্ট বিবিসি রেডিওর ‘ফোর পিএম’ প্রোগ্রামে বলেন যে, ‘এই প্রস্তাবনা পাসের অর্থ ইসরাইল এখন মূলত পরবর্তী ১৫ দিনের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ রাখতে একটি বাধ্যবাধকতার অধীনে থাকবে।’ তিনি যোগ করেছেন, এই প্রস্তাবনাটি আইনত ইসরায়েলের জন্য বাধ্যতামূলক, কিন্তু হামাসের জন্য নয়। কারণ ফিলিস্তিনি গ্রুপটি একটি রাষ্ট্র নয়।জাতিসংঘের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনাগুলো আন্তর্জাতিক আইন, ‘সুতরাং এগুলো আন্তর্জাতিক আইনের মতোই বাধ্যতামূলক।’