ভুলে ভরা এনআইডি
|
১৪ চৈত্র ১৪৩০ |
Thursday, March 28, 2024
পিংকু বিশ্বাস মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার নিজবাহাদুরপুর ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি ২০২০ সালে নতুন ভোটার হন। একই বছর স্মার্ট এনআইডি কার্ড পান। কিন্তু স্মার্ট কার্ড হাতে পেয়েই বিস্মিত হন তিনি। কারণ স্মার্ট কার্ডে তার ছবির পাশে নামের জায়গায় মনি রানী বিশ্বাস লেখা। এমনকি মা-বাবার নামও ভিন্ন। স্থানীয় নির্বাচন অফিসের লোকজন পিংকু বিশ্বাসের হাতে যে স্মার্ট এনআইডি কার্ড (নম্বর ৬৯১২২৭৯৩৭৬) হস্তান্তর করে তাতে ‘পিংকু বিশ্বাসের ছবি ও স্বাক্ষর ব্যতীত সব তথ্য মনি রানী বিশ্বাস (যার পৃথক এনআইডি নম্বর ৩৭৬২১১৮৬১৪) নামে এক নারীর। তাত্ক্ষণিক পিংকু বিশ্বাস বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু নির্বাচন অফিসের লোকজনের সংশোধন করে দেওয়ার আশ্বাসে ভুল কার্ডটিই গ্রহণ করেন।
এখন ভুলে ভরা এই স্মার্ট কার্ড নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন পিংকু বিশ্বাস ও তার পরিবার। প্রয়োজনীয় কোনো কাজেই ব্যবহার করতে পারেন না এনআইডি। উলটো প্রতিনিয়ত নানা হয়রানি, বিড়ম্বনা ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। বন্ধ হয়ে গেছে পড়াশোনা।
জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্ষেপে এনআইডি কার্ড হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক নথি, যা বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া যেকোনো মানুষ পাওয়ার অধিকারী। ২০১৬ সালের আগের জাতীয় পরিচয়পত্রে শুধু ব্যক্তির নাম, পিতা ও মাতার নাম, জন্মতারিখ, আইডি নম্বর, ছবি ও স্বাক্ষর উল্লেখ ছিল। ২০১৬ সালে দেওয়া স্মার্ট কার্ডে একটি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট কার্ড (আইসিসি) সংযুক্ত আছে, যা চিপ কার্ড নামেও পরিচিত। স্মার্ট কার্ডে এ চিপ কার্ড মেশিনের সাহায্যে রিড করা যায়। এই স্মার্ট কার্ডে নাগরিকের সব তথ্য সংরক্ষিত আছে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের এনআইডি বিভাগ নাগরিকদের পরিচয়পত্র সরবরাহ করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য যদিও ছিল নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি। পরবর্তীকালে চাকরি, জমি রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট তৈরি, ব্যাংক হিসাব খোলা, মোবাইল সিম কার্ড কেনা, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব কাজেই এখন জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। স্বাভাবিকভাবে আশা করা গিয়েছিল, পরিচয়পত্রটি নির্ভুল ও ত্রুটিমুক্ত হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সেবার অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায়সারা কাজ করেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
প্রথম আলোর আক্কেলপুর প্রতিনিধির পাঠানো খবরে একটি পরিবারের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অনেক পরিবারের বা নাগরিকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বালাইট পূর্ব পাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোছলিম উদ্দীনের প্রকৃত বয়স ৭৫ বছরের বেশি। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর জন্মতারিখ লেখা আছে ২৮ অক্টোবর ১৯৫৯। তাঁর স্ত্রী মোছা. ছুরতন বেগমের জন্ম ২৪ এপ্রিল ১৯৬২, যা তাঁর প্রকৃত বয়সের চেয়ে অনেক কম। সবচেয়ে হাস্যকর যে তাঁদের বড় সন্তান সোবহানের বয়স দেখানো হয়েছে ১ জুন ১৯৬৩। বাবার চেয়ে চার বছর ও মায়ের চেয়ে ১০ মাস কম। এই বৃদ্ধ বয়সে মোছলিম উদ্দীন ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করলেও সরকারের কাছে বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করতে পারছেন না জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কম লেখার কারণে। বগুড়ার ধুনট উপজেলায় একজন মহিলার স্বামীর নামের স্থলে বাবার নাম দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কেবল কালাই বা ধুনট উপজেলা নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় খোঁজ নিলে লাখ লাখ ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যাবে। পরিচয়পত্রের ভুলের কারণে নাগরিকেরা পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অনেকে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, বয়স সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হলে বিয়ের কাবিননামাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু মোছলিম উদ্দীন ও ছুরতন বেগমের মতো বয়সী মানুষের অনেকের কাবিননামাই নেই। তাঁরা কেন প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন?
নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বর্তমান লোকবল দিয়ে নির্ভুল পরিচয়পত্র দেওয়া সম্ভব কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে দায়িত্বটি অন্য কোনো সংস্থার কাছে ন্যস্ত করার কথাও উঠেছিল। ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্রগুলো অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন। জাতীয়ভাবে নাগরিকদের একটি নির্ভুল ডেটাবেইস বা উপাত্ত ভিত্তি তৈরি হলে কাজটি সহজ হতো।